খালি মাথাতেই মোটরবাইক যাত্রা। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
হাতে হেলমেট ঝুলিয়ে বনগাঁর একটি পেট্রোল পাম্পে ঢুকলেন যুবক। মোটর বাইকের পিছনে সওয়ার ঝাঁ চকচকে তরুণী। পাম্পে ঢোকার মুখে হেলমেট মাথায় চাপিয়ে তেল ভরে কিছুটা এগোতে না এগোতেই হেলমেট খুলে ফের হাতে নিয়ে নিলেন যুবকটি। আঙুল চালিয়ে চুল ঠিক করে ফের স্টার্ট নিল দু’চাকা।
পাম্প কর্মীর স্বগতোক্তি, ‘‘নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনলে কে ঠেকাবে!’’
সব জেনেবুঝেও আপনারা তেল দিচ্ছেন কেন? প্রশ্ন শুনে হতাশ গলায় পাম্পের কর্মী জবাব দিলেন, না দিলেই তো গালিগালাজ, হম্বিতম্বি। কদ্দিন সহ্য করব সে সব। সব বুঝেও মুখ বুজে কাজ করে যাচ্ছি।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নো হেলমেট নো পেট্রোল’ বিধি শুরুতে রীতিমতো ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল মোটর বাইক, স্কুটি চালকদের। পথেঘাটে পুলিশ ধরছিল। শত অনুরোধেও হেলমেট ছাড়া তেল মিলছিল না পাম্পে। সব দিব্যি চলছিল। ভাড়ায় মিলছিল হেলমেট। এমনকী, হেলমেট চুরির ঘটনাও সামনে আসছিল। তা নিয়ে হাসাহাসি যেমন কম হয়নি, তেমনই পথ নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে হেলমেট পরাটা যে বাধ্যতামূলক, সেই বোধটাও ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল আম জনতার মধ্যে।
কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, হেলমেট-বিধি যেন ক্রমেই শিথিল হচ্ছে। পথেঘাটে হেলমেটহীন চালকদের সংখ্যা ফের বাড়ছে বনগাঁর পথেঘাটে।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পর থেকে বেশ কড়া পদক্ষেপ করা হচ্ছিল। নিয়মিত গুরুত্বপূর্ণ সড়কে চলতে থাকে অভিযান। পুলিশি ধরপাকড়ের ভয়েই হোক কিংবা সচেতনতা বাড়ার কারণেই হোক, হেলমেট পড়ার প্রবণতা বেড়েছিল। দোকানে দোকানে হু হু করে হেলমেট বিক্রি হচ্ছিল।
কিন্তু ক্রমশ বদলাচ্ছে পরিস্থিতি।
এক দিকে যখন জেলার প্রতিটি থানা ‘সেভ ড্রাইভ সেভ লাইভ’ কর্মসূচি নিচ্ছে, তখন হেলমেটহীন বাইক সওয়ারিও আকছার দেখা যাচ্ছে পথেঘাটে। জেলা পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এটা একটা দীর্ঘ মেয়াদী অনুশীলন। আইনি পদক্ষেপের পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করতে নানা কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। পরিস্থিতি রাতারাতি একেবারে বদলে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে পুলিশি উদ্যোগের ফল মিলবে অদূর ভবিষ্যতে।’’
বাস্তব পরিস্থিতিটা ঠিক কী রকম, তা দেখতে বনগাঁ, বাগদা, গাইঘাটা, হাবরা, অশোকনগর থানা এলাকার বিভিন্ন সড়কে ঢুঁ মেরে দেখা গেল। যশোর রোড, চোংদা-মছলন্দপুর, জিরাট রোড, বনগাঁ-চাকদহ রোড, বনগাঁ-বাগদা রোড-সহ বিভিন্ন সড়কে ঘুরে নজরে এল, মোটর বাইক চালকদের অনেকেরই মাথায় হেলমেট নেই। পিছনে যিনি বসে আছেন, তাঁর মাথায় তো নেই-ই। চালক-আরোহী দু’জনেরই মাথায় হেলমেট রয়েছে, এমন বাইকের সংখ্যা নেহাতই হাতেগোনা।
অশোকনগরে এক যুবক স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে মোটর বাইকে যাচ্ছিলেন। স্ত্রী এবং নিজের মাথায় হেলমেট থাকলেও আড়াই বছরের ছেলের মাথা খালি। রেলগেট পরায় দাঁড়িয়েছিলেন। ছেলের মাথায় হেলমেট নেই কেন, প্রশ্নটা করার সুযোগ পাওয়া গেল। আমতা আমতা করে যুবক বললেন, ‘‘না, মানে কেনা হয়ে ওঠেনি।’’ তরুণী স্ত্রী কোনও মতে চোখ সরিয়ে অস্বস্তি কাটানোর চেষ্টা করলেন।
তবে বনগাঁ বা হাবরা শহরে পরিস্থিতিটা কিছুটা হলেও আশাব্যঞ্জক। এখানে পুলিশি নজরদারি বেশি। ফলে হেলমেট পরে বাইক চালানোর দৃশ্য দেখা যাচ্ছে এখনও। যদিও এখানে আরোহীর মাথায় হেলমেট থাকছে কম। গ্রামীণ এলাকায় অবশ্য হেলমেট ছাড়া বাইক চালানোর প্রবণতা এখনও বেশি। বাইকে হেলমেট রয়েছে, অথচ চালক তা না পড়ে হাতে ঝুলিয়ে রেখেছেন, এমন ছবি বেশ কিছু ধরা পড়ল। আবার অনেকে শহরে ঢোকার মুখে হেলমেট পরে নিচ্ছেন, সেটাও
দেখা গেল।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশের আগেই গত জানুয়ারি মাসে বনগাঁর এসডিপিও অনিল রায় মহকুমার চারটি থানাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, হেলমেটহীন বাইক চালক ও আরোহীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার জন্য। তারপরে পুলিশের পক্ষ থেকে নজরদারিও শুরু হয়। সাফল্য আসতে শুরু করে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরে পুলিশি পদক্ষেপ আরও কড়া হয়েছিল। ফলে হেলমেট পরাটা কার্যত নিয়ম হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। অনিলবাবু নিজে রাস্তায় নেমে এখনও হেলমেটহীন বাইক ধরছেন। কিন্তু পুলিশ রাস্তায় না থাকলেই হেলমেট পরা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন শহরবাসী। এক পুলিশ কর্তার কথায়, ‘‘বাইক চালক ও আরোহীরা যদি না বোঝেন, হেলমেট ছাড়া বাইক চালানো মানে আত্মহত্যার সামিল— তা হলে শুধু কি আইন দিয়ে কাজ হাসিল হবে?’’ বছর বাইশের এক তরুণকে প্রশ্ন করা গিয়েছিল, হেলমেট পরলে অসুবিধা কী হয় বলুন তো? উত্তর মিলল, চুল নষ্ট হয়ে যায়।
চুলের দাম বেশি না প্রাণের— এই সরল প্রশ্নের উত্তর বোঝাতে আরও কত দিন লাগবে, সেই প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে বাতাসে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy