Advertisement
০২ মে ২০২৪
কোণঠাসা ভাষা
International Mother Language Day

চাষাভুষোর বাংলাকেও সমান মর্যাদায় গ্রহণ করতে হবে বাঙালিকে

উল্টো দিকে, যদি আমরা পশ্চিমবঙ্গের কথা ধরি, তা হলে দেখব— আমাদের অনেক কিছুই হয় তো আছে, কিন্তু ভাষাগত কোনও ঐক্য চেতনা কোনও দিনই সে ভাবে নেই।

ভাষা দিবসের স্মরণে স্মারক। বনগাঁর বিএসএফ ক্যাম্প মোড়ে। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক

ভাষা দিবসের স্মরণে স্মারক। বনগাঁর বিএসএফ ক্যাম্প মোড়ে। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক

সীমান্ত গুহঠাকুরতা
শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৮:২৫
Share: Save:

একটা বড় গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের ভাষা তার সমাজ-অর্থনীতিকে কতখানি প্রভাবিত করতে পারে, প্রশ্নটা অনেক সময়েই ভাবায়। বাংলা ভাষার কথাই ধরা যাক। এই ভাষা পাশাপাশি দুই বঙ্গে দু’ভাবে ব্যবহৃত। আমাদের পড়শি বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি তৈরিই হয়েছিল সে দেশের নাগরিকদের ভাষাগত সত্ত্বার উপরে ভিত্তি করে। ভাষাই সেখানকার মানুষকে স্বাধীনতার দাবিতে জোটবদ্ধ করেছিল। এখনও রেখেছে। তৃতীয় বিশ্ব তথা ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলাদেশ যে উন্নয়নের একটা নিজস্ব ধারাবাহিকতা কায়েম রাখতে পেরেছে তার প্রধান কারণ সম্ভবত ওই সামাজিক ঐক্য— যা ভাষার সুতোয় গাঁথা।

উল্টো দিকে, যদি আমরা পশ্চিমবঙ্গের কথা ধরি, তা হলে দেখব— আমাদের অনেক কিছুই হয় তো আছে, কিন্তু ভাষাগত কোনও ঐক্য চেতনা কোনও দিনই সে ভাবে নেই। পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ বাসিন্দা মধ্যবিত্ত হিন্দু। প্রাক-স্বাধীনতা পর্বে এঁরা এ দেশের মুসলিমদের তুলনায় আর্থিক ভাবে বেশি সম্পন্ন এবং শিক্ষা-দীক্ষায় খানিকটা এগিয়ে ছিলেন। এই এগিয়ে থাকার সুফল হিসেবে তাঁরা পেয়েছিলেন শাসক ইংরেজদের সান্নিধ্য। ইংরেজরা তাদের রাজকার্যে প্রধানত এই হিন্দু বাঙালিদেরই নিয়োগ করত। সে কারণেই কাজ চালানোর মতো ইংরেজিও তাঁদের শিখিয়ে-পড়িয়ে নিত। সেই সূত্রে ‘শাসকের ভাষা’র প্রতি আকর্ষণ আজও এ পার বাংলার বর্ণহিন্দু মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের যায়নি। আজও তাই বাংলা অনেকেরই সিলেবাসে ‘সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ’ হয়ে থেকে গিয়েছে। ‘ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ’-এর জায়গা দখল করেছে ইংরেজি, এমনকী হিন্দিও।

হিন্দি কেন?

বা রে! ওটাও তো আজকের শাসকেরই ভাষা। ঠিক যে কারণে ইংরেজরা আসার আগে মুঘলদের সময়ে এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিন্দুরা উর্দু বা ফার্সি বলতে-লিখতে পারাকে বিশেষ গর্বের মনে করতেন।

খেয়াল করে দেখবেন, পশ্চিমবঙ্গে নানা সামাজিক প্রেক্ষিতে ‘বাংলা’ শব্দটা সব সময়েই নিচুমানের অথবা তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন জুডো-ক্যারাটের বিপরীতে এলোপাথারি ‘বাংলা মার’। ‘স্কচ-হুইস্কির বিপরীতে ‘বাংলা মদ’। কিংবা ওড়িশা থেকে আসা ‘মিঠে পাতার পান’-এর বিপরীতে ঈষৎ কষাটে ‘বাংলা পাতা’।

উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই। ‘বাংলা’-র প্রতি এই তো এপার-বাংলার বাঙালিদের দৃষ্টিভঙ্গি!

পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের এটাও একটা বড় কারণ বলে মনে হয়। আমাদের এমন কোনও ‘সাধারণ’ (কমন) পরিচিত নেই, যা আমাদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে। সম্প্রদায়ের দিক থেকে দেখতে গেলে আমরা আদৌ ‘এক’ নই, ‘অনেক’। সেখানে হিন্দু-মুসলমান যেমন আছে, তেমনই হিন্দুদের মধ্যেই নানা উপবিভাগ বিদ্যমান। (বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও এই বর্ণগত বিভেদ যে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মধ্যে ষোলআনার উপরে আঠারো আনা আছে— তা খবরের কাগজের পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপনগুলিতে এক বার চোখ বোলালেই স্পষ্ট হয়)

আর আর্থিক দিক থেকে তো এপার বাংলা বরাবরই বৈষম্যের শিখরে। যত দিন যাচ্ছে, শহুরে উচ্চবিত্ত আর গ্রামীণ দরিদ্রের জীবনযাপনের পার্থক্য আরও কুৎসিত, আরও বেআব্রু হয়ে পড়ছে।

কাজেই একমাত্র যে জিনিসটা এই দুর্দিনে আমাদের একজোট রাখতে পারত, তা হল ভাষা। কিন্তু মুশকিল হল, বাংলা ভাষাটা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের কোনও দিনই খুব একটা আপন হয়ে উঠতে পারেনি। নামেই তা মাতৃভাষা। কিন্তু ‘মা’কে তো শুধু উৎসবের দিনে অথবা অতিথি এলে সাজিয়ে গুজিয়ে রাখলে চলে না। সারা বছর তাঁর দেখাশোনা, যত্নআত্তি করতে হয়। কিছু ক্রনিক অসুখ থাকে, যা ওষুধে সারে না। সে জন্য ‘লাইফস্টাইল’ বা জীবনযাপনের পদ্ধতি বদলানো দরকার হয়। বাংলা ভাষার নিরন্তর ষত্ন না নিলে তাই ভাষার অসুখ সারবে না। প্রতিবেশী বাংলাদেশকে দেখে আমরা শিখতে পারি, কী ভাবে একটা জাতি একটা ভাষাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকতে পারে। আমরা যদি তাদের মতো ভাষাকে অস্তিত্বের সমার্থক করে তুলতে পারি, তবেই জাতিগত ভাবে আমাদের উন্নতি সম্ভব।

এর জন্য সবার আগে কলকাত্তাইয়া মান্য বা স্ট্যান্ডার্ড বাংলার অহংকার ছাড়তে হবে। গ্রামদেশের চাষাভুষোর বাংলা, ট্রেনের হকারের বাংলা, অটো চালকের বাংলা, মেদিনীপুর-মুর্শিদাবাদ-পুরুলিয়ার বাংলা— সব বাংলাভাষাকে সমান মর্যাদায় গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষিত মধ্যবিত্তর ভাষাগত আধিপত্য দেখালে চলবে না। শিক্ষিত বাঙালির পক্ষে কাজটা কঠিন, খুবই কঠিন।

বাংলা ভাষাটা তাই ওই ইলিশ, চিংড়ি, রসগোল্লা আর ধুতি-পাঞ্জাবির মতোই একটা জাতির ‘টোটেম’ বা ধারণচিহ্ন হয়েই থেকে যাবে। বর্ষা পড়লে যেমন ধনী বাঙালি বারোশো টাকা কিলোর ইলিশ খায়, বিয়েবাড়ি গেলে যেমন গলদা চিংড়ি পাতে পড়ে, ঠিক তেমনই প্রতি বছর পঁচিশে বৈশাখ আর একুশে ফেব্রুয়ারি ধুতি-পাঞ্জাবি পড়ে মাতৃভাষা নিয়ে গর্বে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে। এর বেশি কিছু আশা করা বাতুলতা।

লেখক একজন শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

International Mother Language Day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE