ডাকাত সন্দেহে শিক্ষকদের গ্রেফতারের ঘটনায় অসন্তোষ দানা বেঁধেছে হিঙ্গলগঞ্জের শিক্ষকদের মধ্যে। বৃহত্তর আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছেন তাঁদের একাংশ। শিক্ষকদের মুক্তি এবং দোষী পুলিশ কর্মীদের শাস্তির দাবিতে মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হওয়ার কথা ভাবছেন ধৃত শিক্ষকদের একাংশ। রবিবার বসিরহাট স্টেশনে প্ল্যাকার্ড হাতে বসে বিক্ষোভ দেখান কিছু শিক্ষক ও পড়ুয়া। যদিও শিক্ষকদেরই একটি অংশ জানাচ্ছে ঘটনার প্রতিবাদে বড় রকম আন্দোলন দানা বাঁধার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চাপ আছে। ধৃত শিক্ষকদের কেউ কেউ তৃণমূলের নেতা কর্মী। আচমকা শিক্ষকদের ‘সশস্ত্র অবস্থায় ডাকাতির উদ্দেশ্যে জড়ো হওয়া’-র মতো অভিযোগে গ্রেফতার করা নিয়ে বিব্রত পুলিশ মহলের একাংশও। বিষয়টি নিয়ে একটু ‘বাড়াবাড়ি’ হয়ে গিয়েছে বলেই তাঁদের মত। ঘটনার কথা কানে পৌঁছেছে খোদ শিক্ষামন্ত্রীর। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের দ্রুত জামিনে ছাড়িয়ে এনে ‘সুবিচার’ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে তৃণমূল শিবিরেও। ফলে শিক্ষকদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে উঁচু স্বরে আন্দোলন গড়ে উঠুক, তা চান না দলের একাংশ।
গত বৃস্পতিবার রাতে আড়িয়াদহ থেকে গ্রেফতার করা হয় হিঙ্গলগঞ্জের সাত শিক্ষককে। একই সঙ্গে ধরা হয়েছিল হুগলির এক শিক্ষককেও। সকলেই ৫ অগস্ট থেকে বেলঘরিয়ার আড়িয়াদহে একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকছিলেন। চাকরির ‘আপগ্রেডেশন’ পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল তাঁদের। সিট পড়েছিল হিন্দু স্কুলে। কিন্তু তাঁর আগেই বৃহস্পতিবার রাতে আচমকা পুলিশ গ্রেফতার করে সকলকে। আপাতত তাঁরা জেল হাজতে।
ওই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ৩৯৯/৪০২ ধারায় মামলা রুজু করেছে পুলিশ। আদালতে দাখিল করা নথিতে পুলিশ দাবি করেছে বৃহস্পতিবার রাতে আড়িয়াদহে গঙ্গার ধারে সন্দেহজনক ভাবে ঘোরাঘুরি করছিল কয়েকজন। তাড়া করলে পালায় কেউ কেউ। ধরা পড়ে ওই আটজন। তাদের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে।
পুলিশের দাবির সঙ্গে এলাকাবাসীর বয়ানের বিস্তর ফারাক আছে। শনিবার আড়িয়াদহে গিয়ে জানা যায়, ভাড়াবাড়ির ঘর থেকেই পুলিশ ধরে নিয়ে যায় সকলকে। এমনকী বাড়ির মালকিনকে দিয়ে সাদা কাগজে লিখিয়ে নেয় যে, বাড়িভাড়া যারা নিয়েছিল তাদের আচরণ ‘সন্দেহজনক’ ছিল। যদিও স্থানীয় একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, কামারহাটি পুরসভার কাউন্সিলর স্বপন মণ্ডলের কাছ থেকে পাওয়া খবরের ভিত্তিতেই পুলিশ গ্রেফতার করে সকলকে। সে কথা যদিও পরে মানতে চাননি স্বপনবাবু।
হিঙ্গলগঞ্জে যে সাতজন শিক্ষক ডাকাত সন্দেহে ধরা পড়েছেন তাঁদের মধ্যে কয়েকজন প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক আছেন। গোটা ঘটনায় তাঁদের আত্মীয় পরিজন, সহকর্মীরা ক্ষুব্ধ। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যেও তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। সকলেরই বক্তব্য, পুলিশ গ্রেফতার করার আগে কেন সকলের পরিচয় খোঁজ করল না। কেনই বা বাড়ির লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল না। ধৃত এক শিক্ষকের কলেজ পড়ুয়া ছেলে বলেন, ‘‘ওঁরা যে সকলেই শিক্ষক সে ব্যাপারে যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও পুলিশ সে সব খতিয়ে না-দেখেই কেন গ্রেফতার করতে গেল? সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মীদের কড়া শাস্তি হওয়া উচিত। বাবার মুক্তির দাবিতে এবং পুলিশ কর্মীদের বিরুদ্ধে শাস্তি চেয়ে শিক্ষা কাউন্সিল, শিক্ষামন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’ শিক্ষকদের মুক্তির দাবিতে শনিবার বসিরহাটের মহকুমাশাসকের কাছ স্মারকলিপি দেওয়ার কথা ছিল শিক্ষকদের। শেষমেশ তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের মধ্যস্থতায় সেই সিদ্ধান্ত আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষকদের কেউ কেউ। তাঁদের দাবি, তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্বও গোটা ঘটনায় ক্ষুব্ধ ও উদ্বিগ্ন। দ্রুত শিক্ষকদের মুক্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে আশ্বস্ত করেছেন তাঁরা।
তৃণমূলের দুলদুলি অঞ্চল সভাপতি বিধান মণ্ডল অবশ্য মনে করেন বিষয়টি গুরুতর। ঘটনার প্রতিবাদে ধৃত এক শিক্ষকের ভাইপো বলেন, ‘‘ওঁদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগটুকু পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। পরিবারের লোকজনকেও জানানো হয়নি। আইন রক্ষার নামে গুন্ডামি করেছে পুলিশ।’’
রমাপুর প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক কমল মণ্ডল বলেন, ‘‘ওঁদের অনেককেই চিনি। কেউ কারও অচেনা হতেই পারেন। কিন্তু তাই বলে এ ধরনের আচরণ করা হবে তাদের সঙ্গে। এর পরে তো এক পাড়ার লোক অন্য পাড়ায় গিয়ে থাকতে ভয় পাবে।’’ তাঁর বক্তব্য, পুলিশ কিছু খতিয়ে না-দেখেই যে ভাবে কয়েক জন শিক্ষককে ডাকাত সন্দেহে গ্রেফতার করল তাতে আমরা সকলেই আতঙ্কিত বোধ করছি। কানাইহাটি হাটখোলা প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক অরিজিৎকুমার বিশ্বাসের কথায়, ‘‘ঘটনাটা প্রথমে শুনে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। ’’ তিনি জানান, ধৃত এক শিক্ষক তাঁর খুবই পরিচিত। যাঁর সম্প্রতি হৃদযন্ত্রের অস্ত্রোপচারও হয়েছিল। পুলিশের আচরণকে অমানবিক বলে সমালোচনা করেন তিনি।
শিক্ষক দীপক পাত্র, তাপস বাউলিদের মতে, এই ঘটনায় সমস্ত শিক্ষকেরই অপমান হয়েছে। হিঙ্গলগঞ্জের বাসিন্দা অমিত মণ্ডল, কৃষ্ণপদ মণ্ডল, বিপ্লব দাস শিক্ষকদের এই ‘অপমান’ গোটা হিঙ্গলগঞ্জবাসীর ক্ষেত্রেই অসম্মানজনক বলে মনে করেন। সিপিএমের শিক্ষক সংগঠনের তরফেও ঘটনার সমালোচনা করা হয়েছে।
রবিবার বসিরহাট স্টেশনে যাঁরা শিক্ষকদের গ্রেফতারির প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে উত্তর কাঁঠালবেড়িয়া প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক অরবিন্দ মণ্ডল বলেন, ‘‘শিক্ষকদের অবিলম্বে নিঃশর্তে মুক্তি দেওয়া না-হলে আমরা বৃহত্তর আন্দোলনে নামতে বাধ্য হব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy