Advertisement
E-Paper

জলের অভাব, বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে পাটচাষিরা

দু’পয়সা লাভের আশায় কেউ জমি লিজ নিয়ে, কেউ বা নিজের জমিতে পাট চাষ করেছেন। কিন্তু তাঁদের সেই আশার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে তীব্র দাবদাহ। জলের অভাবে কোথাও পাটের গোড়া শুকিয়ে গিয়েছে, গাছ নুয়ে পড়েছে। পাট চাষের এমন অবস্থার ছবি নজরে পড়ল বনগাঁ সীমান্ত লাগোয়া গ্রামগুলিতে।

সীমান্ত মৈত্র

শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৫ ০১:০৪
শুকিয়ে যাচ্ছে পাটগাছের পাতা। নির্মাল্য প্রামাণিকের তোলা ছবি।

শুকিয়ে যাচ্ছে পাটগাছের পাতা। নির্মাল্য প্রামাণিকের তোলা ছবি।

দু’পয়সা লাভের আশায় কেউ জমি লিজ নিয়ে, কেউ বা নিজের জমিতে পাট চাষ করেছেন। কিন্তু তাঁদের সেই আশার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে তীব্র দাবদাহ। জলের অভাবে কোথাও পাটের গোড়া শুকিয়ে গিয়েছে, গাছ নুয়ে পড়েছে। পাট চাষের এমন অবস্থার ছবি নজরে পড়ল বনগাঁ সীমান্ত লাগোয়া গ্রামগুলিতে।

সীমান্ত লাগোয়া ভিড়ে গ্রামের চাষি আরাজুল ইসলাম মণ্ডল এ বার ২ বিঘা ৫ কাঠা জমি লিজ নিয়ে পাট চাষ করেছেন। দুপুরে তাঁর ওই জমিতে গিয়ে দেখা গেল, তীব্র দাবদাহে শুকিয়ে নুয়ে পড়েছে পাট গাছ। পাটের গোড়া শুকিয়ে গিয়েছে। ফেটে গিয়েছে মাটিও। খেতের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে মরা পাট গাছ তুলে দেখাচ্ছিলেন আরাজুল। এক ঝলক আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘প্রতি বিঘা জমি চার হাজার টাকায় লিজ নিয়ে পাট করেছি। আর বিঘে প্রতি পাট চাষ করতে খরচ হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। তীব্র গরমে পাট মরতে শুরু করছে। পরিস্থিতি এমন যে লাভের আশা ছেড়ে দিয়েছি।’’ একটু থেমে বলেন, ‘‘চাষের খরচ উঠবে কি না তাও নির্ভর করছে কত দ্রুত বৃষ্টির দেখা মেলে তার উপর!’’

শুধু আরাজুলের নয়। পাট চাষের এমনই অবস্থা গোটা উত্তর ২৪ পরগনা জেলায়। জেলার চাষিরা জানালেন, বৃষ্টি না হলে পাট মোটাও হয় না। রংটাও ফোটে না। আরাজুল জানালেন, ‘গত বছরও এই সময়ে বৃষ্টি হয়েছিল। পাট লম্বায় বেশ ভালই হয়েছিল। এ বার বেশির ভাগ পাট বুক সমান লম্বা হয়েছে। জেলা কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এ বার গোটা জেলায় ৩১ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে পাট হয়েছে। পাট চাষের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন দেড় লক্ষেরও বেশি চাষি। জেলা পাট উন্নয়ন আধিকারিক দুলাল বিশ্বাস বলেন, ‘‘এক সপ্তাহের মধ্যে বৃষ্টির দেখা না গেলে জেলাতে পাট চাষে প্রভাব পড়বে অনেক বেশি।’’

পাট চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বৃষ্টির অভাবে খেত ফেটে যাচ্ছে। পাট পাতা শুকিয়ে পড়লেও শ্যালোর মাধ্যমে সেচ দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। কারণ জানালেন বনগাঁর চাষি আব্দুল রসিদ। তিনি এ বার চার বিঘে জমিতে পাট করেছেন। বললেন, ‘‘চৈত্র মাসে পাট লাগিয়েছি। শ্রাবণ মাসে পাট কাটার কথা। অনেক চাষি ইতিমধ্যেই পাট কেটে সেখানে ধান চাষ করার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। এই তীব্র দাবদাহে বিঘে প্রতি পাট খেতে সেচ দিতে খরচ দেড় হাজার টাকা। ওই খরচ কোথা থেকে আসবে। ইতিমধ্যেই পাটের ক্ষতি হতে শুরু করেছে। দ্রুত বৃষ্টি না হলে আমাদের আর ক্ষতির সীমা থাকবে না।’’ একই আশঙ্কার কথা শোনালেন বনগাঁর পাইকপাড়া গ্রামের পাট চাষি ফজলু মণ্ডল। তিনি দেড় বিঘে জমিতে পাট করেছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘পাটের যা পরিস্থিতি তাতে সম্পূর্ণ লোকসান। এখন জ্বালানির কাজে ব্যবহার করা ছাড়া পাট আর কোনও কাজে আসবে না।’’

চাষিরা জানালেন, বহুদিন হতে চলল বৃষ্টির দেখা নেই। মাটির নীচের জলস্তর নেমে যাচ্ছে। পাম্পে ঠিক মতো জল উঠছে না। খালবিল, নদী, কাঁদরের জল শুকিয়ে যাওয়ায় সেচের জল পাওয়া যাচ্ছে না। রোদে খেতের ফসল ঝলসে যাচ্ছে। জলের অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে পাটের পাতা থেকে গোড়া। শ্যালোর মাধ্যমে খেতে জল দেওয়ার মতো আর্থিক পরিস্থিতি বহু চাষিরই নেই। তা ছাড়া, শ্যালোর মাধ্যমে পাট খেতে জল দিলে তা গোড়ায় যাবে। চাষিদের বক্তব্য, ‘‘প্রয়োজন পাটের ডগায় জল দেওয়া। যা বৃষ্টি ছাড়া সম্ভব নয়।’’ আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বৃষ্টি না হলে পাট চাষে ব্যাপক ক্ষতি সম্ভবনা বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি আধিকারিকরা। প্রসঙ্গত, বনগাঁ মহকুমায় প্রতি বছর দুর্গা পুজোর আগের বৃষ্টিতে বেশির ভাগ কৃষি জমিতে জল দাঁড়িয়ে যায়। সেই জল নামতে মাস তিনেক সময় লাগে। ওই সময় কোনও ফসল হয় না। মহকুমার বহু এলাকার চাষিদের জমি এখন এক ফসলি জমিতে পরিণত হয়েছে। পাটই তাঁদের কাছে প্রধান চাষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর ওই পাট চাষ এ বার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই সব এলাকার চাষিদের ক্ষোভ, পুজোর আগে পাট বিক্রি করে পুজোয় তাঁরা খরচ করে থাকেন। পরিবারের লোকেদের নতুন জামা কাপড় কিনে দেন। বারাসতের রমজান আলি, বসিরহাটের বাবলু তরফদার বা হাবরার ভরত মণ্ডলের আক্ষেপ, ‘‘এমন পরিস্থিতি বহুদিন হয়নি। এক ফোঁটাও বৃষ্টি তো দূরের কথা মেঘেরও দেখা নেই। আর শ্যলোর মাধ্যমে জল দিয়ে কী হবে? এক দিকে যেমন চাষের খরচ বাড়বে। উল্টে ওই টাকা আর ফিরবে না। পরিস্থিতি এমন যে ২-৩ দিন অন্তর খেতে শ্যালোর মাধ্যমে জল দেওয়া প্রয়োজন। যা চাষিদের পক্ষে কার্যত অসম্ভব।’’ এই অবস্থায় জেলা পাট উন্নয়ন আধিকারিক দুলাল বিশ্বাসের পরামর্শ, ‘‘চাষিদের উচিত দুপুরের পরিবর্তে সন্ধ্যার পর পাটের খেতে সেচ দিতে। দুপুরে হলে পুরোটা জল পাট নিতে পারবে না। সন্ধ্যায় সেচ দিলে কয়েকদিন অন্তর অন্তর সেচ দিলেও চলবে।’’

কৃষি দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, প্রথম দিকে যাঁরা পাট চাষ করছেন, তাঁদের সমস্যা কম। কারণ তাঁদের জমির পাটকাঠি মোটা হয়ে গিয়েছে। ওই পাটের সহন ক্ষমতা অনেক বেশি। দেরি করে যাঁরা পাট করেছেন তাঁদের ক্ষতির পরিমান বেশি হওয়ার সম্ভবনা। জেলা উপকৃষি অধিকর্তা(প্রশাসন) অরূপ দাস বলেন, ‘‘বৃষ্টির অভাবে পাটের স্বাস্থ্য কমে গিয়েছে। তবে দ্রুত বৃষ্টি হলে ক্ষতির অনেকটাই পুষিয়ে যাবে।’’

কৃষিকর্তা বা আধিকারিকদের পরামর্শে মন গলছে না চাষিদের। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘এখন বৃষ্টি হলে হয়তো খরচটা কোনও মতে উঠতে পারে। কিন্তু যা অবস্থা বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া আর উপায় নেই।’’

simanta maitra bongaon jute farmers bongaon jute farming jute rain jute water scarcity
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy