Advertisement
E-Paper

মহামূল্যবান, বলেছিলেন অমর্ত্য সেন

প্রাণের চেয়ে প্রিয় সেই সংগ্রহশালা সযত্নে আগলে রেখে রবিবার রাতে চলে গেলেন সেই ‘বোকা’ মানুষটা। রেখে গেলেন, অমূল্য ইতিহাস। যা দেখে এখন এলাকার মানুষ বলছেন, সত্যিই খ্যাপা এত দিন পরশপাথরই খুঁজে ফিরেছে।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৮ ০১:৪৬
নজরবন্দি: প্রত্ন সামগ্রী পাহারায় সিভিক ভলান্টিয়ার। ছবি: সজলকুমার চট্টোপাধ্যায়

নজরবন্দি: প্রত্ন সামগ্রী পাহারায় সিভিক ভলান্টিয়ার। ছবি: সজলকুমার চট্টোপাধ্যায়

লোকে বলত, খ্যাপা।

এলাকায় খোঁড়াখুঁড়ি হলেই ভাঙা ধাতুর মুর্তি, মাটির পাত্র, পাথর কুড়িয়ে নিয়ে যান মানুষটা। পরম যত্নে পরিস্কার করে সাজিয়ে রাখেন ঘরের আলমারিতে। সে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, কী সব যেন লিখে চলেন। গাঁয়ের লোক কেউ কেউ আবার ভাবত, ভারী বোকা মানুষ। কারণ, অনেকের থেকে কিছু টাকা-পয়সা দিয়েও শুঁড়-ভাঙা গণেশের মূর্তি কিনেও নিতেন দিলীপ মৈতে।

সেই সব কুড়িয়ে বাড়িয়ে পাওয়া জিনিসপত্র দেখতেই উত্তর ২৪ পরগনার বেড়াচাঁপায় ছুটে গিয়েছিলেন অমর্ত্য সেনের মতো মানুষজন। সংগ্রহ দেখে অবাক হয়ে সাধুবাদ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, চন্দ্রকেতুগড় আর খনা-মিহিরের ঢিপির এই সংগ্রহ মহামূল্যবান। প্রাণের চেয়ে প্রিয় সেই সংগ্রহশালা সযত্নে আগলে রেখে রবিবার রাতে চলে গেলেন সেই ‘বোকা’ মানুষটা। রেখে গেলেন, অমূল্য ইতিহাস। যা দেখে এখন এলাকার মানুষ বলছেন, সত্যিই খ্যাপা এত দিন পরশপাথরই খুঁজে ফিরেছে।

দিলীপ মৈতের মৃত্যুর পরে প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা ছাড়াও শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন বহু মানুষ। অনেকেই বললেন, ‘‘মাটির তলায় চাপা-পড়া বেড়াচাঁপার সম্মান ফিরিয়ে এনে দিয়েছেন এই মানুষটাই।’’

এলাকার বয়স্ক মানুষেরা জানান, প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে পুকুর খুঁড়তে গিয়ে হঠাৎই বিভিন্ন ধাতব প্রত্নসামগ্রী, মুদ্রা মিলতে থাকে। সে সব সংগ্রহ করে বাঁচিয়ে রেখেছেন দিলীপবাবু। বিভিন্ন আকারের অসংখ্য টেরাকোটার গণেশ মূর্তি, ধাতব মুদ্রা, পাত্র, সিলমোহর, জীবাশ্মের মতো বিভিন্ন জিনিস রয়েছে তাঁর সংগ্রহে।

দিলীপবাবুর লাগাতার চিঠিচাপাটিতে এক সময়ে বেড়াচাঁপায় খনন কার্য শুরু করে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ। মাটির ছ’ধরনের স্তর থেকে প্রাক মৌর্য, শুঙ্গ, কুষাণ, গুপ্ত, পাল যুগের প্রত্ন নির্দশন মেলে। পাওয়া যায়, বিভিন্ন সময়ের মুদ্রা, মূর্তি, সিলমোহর, জীবাশ্ম ও স্থাপত্য নির্দশন। তারপরেই জায়গাটিকে নিজেদের অধীনে নিয়ে সেখানে খনন বা নির্মাণের নিষেধাজ্ঞা জারি করে পুরাতত্ত্ব বিভাগ। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তা-ও এখন নষ্ট হতে বসেছে।

প্রায় আড়াই বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে চন্দ্রকেতুগড়ের পরতে পরতে রয়েছে ইতিহাস। বিশেষজ্ঞেরা জানান, এক সময়ে গোটা দেগঙ্গা, বেড়াচাঁপাই ছিল ‘গড়’। আলেকজান্ডারের সময়ে এ বঙ্গের বিদ্যাধরী নদীর ধারে রাজত্ব করতেন রাজা চন্দ্রকেতু। তাঁর রাজধানী দেশবিদেশে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবেও খ্যাতি ছড়িয়েছিল। কেউ বলেন, মেগাস্থিনিসের বর্ণনার শৌর্যশালী, ইবন বতুতার প্রভাবশালী রাজা চন্দ্রকেতুই। তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য আলেকজান্ডার সেনাপতি সেলুকাসকে পাঠিয়েছিলেন। চন্দ্রকেতুর প্রভাব ও রাজসভার কারুকাজ দেখে সেলুকাসও মুগ্ধ হন। সে সব আজ নষ্ট হতে বসা আড়াই হাজার বছরেরও পুরনো ইতিহাস।

তবে সে সব ইতিহাস মুছে যেতে দেননি দিলীপবাবু। বহু টাকার বিনিময়ে সংগ্রহের কিছু জিনিস কেনার প্রস্তাবও তাঁর কাছে আসে। খেপে উঠে তাদের তাড়িয়ে দিয়ে আরও যত্নে রেখে দেন নিজের সংগ্রহ। ‘ভাল কথায়’ পুরাতত্ত্ব বিক্রিতে রাজি না হওয়ায় হুমকিও আসে। কিন্তু ভয় পাননি দিলীপ। এ সব কারণে তাঁর বাড়ির সংগ্রহশালায় পুলিশ মোতায়েন করেছে প্রশাসন।

সোমবার তাঁর ছেলে দীপন বলেন, ‘‘সরকারি সংগ্রহশালায় এ সব কীর্তি থাকবে, এই ছিল বাবার শেষ ইচ্ছে। নিজের সন্তানের চেয়েও ভালবাসতেন এদের।’’ এ দিন বারাসতের সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার বলেন, ‘‘সংগ্রহশালার কাজ শেষের মুখে। দিলীপবাবুর ইচ্ছে মতো সেখানে প্রত্নসামগ্রী রাখা হবে। এর পুরো কৃতিত্বই ওঁর।’’প্রথম জীবনে শিক্ষকতা পরে স্বাস্থ্যদফতর থেকে অবসর নিয়েছিলেন দিলীপ। কিন্তু অবসর জীবনেই বরং কাজ বেড়ে যায়। সারা দিন ঘুরে ঘুরে পুরাতত্ত্ব সংগ্রহ, ইতিহাস লিপিবদ্ধ করায় ছিল তাঁর নিরলস আগ্রহ। এ হেন মানুষটির মৃত্যুর পরে মহামূল্যবান এ সব সামগ্রীর কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন এলাকার মানুষের। সংগ্রহশালা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত পুলিশ পাহারা থাকবে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।

যদিও সাধের সেই সংগ্রহশালা দেখে যেতে পারলেন না বেড়াচাঁপার খ্যাপা মানুষটা।

Death Archeologists Museum Amartya Sen দিলীপ মৈতে অমর্ত্য সেন
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy