Advertisement
E-Paper

ছাদনাতলায় দাঁড়িয়ে থেকে পাত্র-পাত্রীর বিয়ে দিল পুলিশ

দমাদ্দম ইটের টুকরো এসে পড়ছে লজের জানলায়। অগুনতি উত্তেজিত জনতা হাতে খেটো বাঁশ নিয়ে লজে ঢুকে তাণ্ডব চালাচ্ছে। চেয়ার-টেবিল উল্টে পড়েছে। ভাঙা টিউবের টুকরো এ দিক ও দিক ছড়িয়ে। নিমন্ত্রিতরা ভয়ে সরে পড়েছেন আগেই। এই পরিস্থিতিতেই চার হাত এক হল পাত্রপাত্রীর।

সীমান্ত মৈত্র

শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৫ ০১:৪৭
আচমকাই স্বামীকে হারিয়ে বিহ্বল কল্পনাদেবী। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

আচমকাই স্বামীকে হারিয়ে বিহ্বল কল্পনাদেবী। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

দমাদ্দম ইটের টুকরো এসে পড়ছে লজের জানলায়। অগুনতি উত্তেজিত জনতা হাতে খেটো বাঁশ নিয়ে লজে ঢুকে তাণ্ডব চালাচ্ছে। চেয়ার-টেবিল উল্টে পড়েছে। ভাঙা টিউবের টুকরো এ দিক ও দিক ছড়িয়ে। নিমন্ত্রিতরা ভয়ে সরে পড়েছেন আগেই।

এই পরিস্থিতিতেই চার হাত এক হল পাত্রপাত্রীর। কথা ছিল, চারপাশে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-বন্ধুরা ফুল ছুড়ে নবদম্পতিকে অভিনন্দন জানাবেন। তার বদলে দম্পতিকে ঘিরে গম্ভীর মুখে বসে থাকলেন পুলিশ কর্তারা। শাঁখের শব্দে সেই মাঙ্গলিক মেজাজটাই উধাও। মহিলারা উলুধ্বনি দিলেন দায়সারা ভাবে। সকলেরই মনে ভয়। এই বুঝি ফের চড়াও হয় হামলাকারীরা। রবিবার রাতে গাইঘাটার রামপুরে এ ভাবেই মিটেছে বিয়ের আসর। পাত্রের বাবা বলেন, ‘‘তাণ্ডবের মধ্যে পুলিশি পাহারায় বিয়েটা সম্পূর্ণ হতে পেরেছে। কিন্তু বরযাত্রীরা অনেকেই না খেয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন।’’

বিয়েবাড়ির সামনে নির্মল ঘোষ নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে খুনের অভিযোগে সুস্মিতার জ্যাঠতুতো দাদা দেবদাস মণ্ডলকে সোমবার গ্রেফতার করেছে পুলিশ। খুনের ঘটনার জেরেই নির্মলবাবুর এলাকার লোকজন এসে তাণ্ডব চালায় বিয়েবাড়িতে। চাঁদপাড়া থেকে বরযাত্রী হয়ে গিয়েছিলেন এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘‘গ্রামবাসীরা হাতের সামনে যা পেয়েছে ভাঙচুর করেছে। বাচ্চারা ভয় পেয়ে চিৎকার করছিল। মহিলারাও কান্না জুড়েছিলেন অনেকে। গোটা লজ জুড়ে হঠাৎ আতঙ্কের পরিবেশ। বিয়েবাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে এসে এমন ঘটনার সাক্ষী থাকতে হবে ভাবিনি।’’ তিনি জানান, না খেয়েই বাড়ি ফিরে এসেছিলেন।

কিন্তু গ্রামবাসীরা অনেকে জানাচ্ছেন, উত্তেজনার সঙ্গত কারণ ছিল। কেন? বিয়েবাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে যখন এক জনকে পিটিয়ে, ইট দিয়ে থেঁতলে খুন করা হচ্ছে, তখন খবর জেনেও বিয়েবাড়ি থেকে কেউ দেবদাসকে প্রতিহত করতে আসেননি। সানাইয়ের সুরে হারিয়ে গিয়েছে নির্মলবাবুর আর্তনাদ।

এলাকায় সজ্জন মানুষ হিসাবেই পরিচিতি ছিল তাঁর। বিয়েবাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেক দূরত্বে নির্মলবাবুর বাড়ি। পেশায় দিনমজুর মানুষটি অনেক কষ্টে বড় করেছেন দুই ছেলেমেয়েকে। ছেলে টুকুন বাইরে থাকে কর্মসূত্রে। মেয়ে ঝুমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সম্প্রতি নতুন বাড়ি তৈরি করেছেন নির্মলবাবু। স্ত্রী কল্পনাদবী বললেন, ‘‘রবিবার সন্ধ্যায় সাইকেল নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন উনি। বলে গিয়েছিলেন, মালিকের কাছ থেকে কাজের টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। তারপর যে কী হল কিছুই বুঝতে পারছি না। ওঁর কোনও শত্রু ছিল বলেও তো শুনিনি। দেবদাস বলে যে ওঁকে খুন করেছে বলে শুনছি, তার সঙ্গেও তো ওঁর কোনও বিবাদ ছিল বলে জানি না।’’

চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল কল্পনাদেবীর। রাতে প্রতিবেশীরা জড়ো হয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে। নির্মলবাবুর ভাগ্নে বিজয় ঘোষ বলেন, ‘‘রাত সাড়ে ৮’টা নাগাদ এলাকার দু’টি ছেলে বাড়িতে এসে জানাল, মামাকে কারা যেন মারধর করছে। মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। ছুটে গিয়ে গিয়ে, বিয়েবাড়ির সামনে মামা রাস্তার পাশে অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে আছেন। আমরা ভ্যানে করে তাঁকে নিয়ে যাই এক চিকিৎসকের কাছে। তিনি জানান হৃদস্পন্দন খুবই কম। বনগাঁ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা মামাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।’’ মামাকে কেন দেবদাস খুন করতে গেল, তা বুঝতে পারছেন না বিজয়বাবু।

এলাকায় কান পাতলে দেবদাস সম্পর্কে অভিযোগ শোনা যাবে ভুরি ভুরি। বছর তিরিশের যুবককে ২০০৯ সালেই এক বার খুনের চেষ্টা অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সে বার পারিবারিক বিবাদের জেরে নিজের জেঠাকেই পেটে ছুরি চালিয়ে দিয়েছিল রামপুর-ভাটপাড়ার বাসিন্দা ওই যুবক। কিছু দিন জেল খেটে জামিনে ছাড়া পেয়ে হোটেলে কাজ নিয়ে মুম্বই পাড়ি দিয়েছিল। কিন্তু মাঝে মধ্যে যখন ফিরত, তখনই মদ খেয়ে শুরু হত তার দাদাগিরি। এলাকার কিছু উঠতি যুবককে সঙ্গে নিয়ে মোটর বাইকে দাপিয়ে বেড়াত দেবদাস। একে তাকে কারণে-অকারণে চড়-থাপ্পর মারার ঘটনায় এর আগেও নাম জড়িয়েছে উগ্র স্বভাবের ওই যুবকের। পাড়া-পড়শিরাও সাধ্য মতো এড়িয়ে চলতেন তাকে।

দেবদাস সম্পর্কে মুখে কুলুপ এঁটেছেন পাত্রীর বাড়ির লোকজন। তবে পুলিশ জানতে পেরেছে, এক জনকে পিটিয়ে ঘায়েল করে ধোপদূরস্ত জামাকাপড় পরে দিব্যি বিয়েবাড়িতে ফিরে মাতব্বরি শুরু করেছিল সে। শোনা যাচ্ছে, বন্ধু-বান্ধবদের ডেকে দেবদাস নিজের কীর্তির কথাও ফলাও করে বলেছিল। এলাকার লোকজন অনেকেই জানালেন, দেবদাসের মোটর বাইকের সঙ্গে অসতর্কতাবশত সাইকেল নিয়ে ধাক্কা মেরেছিলেন নির্মলবাবু। মফস্সলে যা নিত্য দিনের ঘটনা। কিন্তু তার জেরে এমন ভয়ঙ্কর ভাবে মারধর করা হবে, তা ভাবতেই পারছেন না কেউ। দেবদাস মদ্যপ অবস্থায় ছিল বলে পুলিশের অনুমান।

গোটা ঘটনায় মাথায় হাত লজমালিক মিহিরকান্তি বিশ্বাসের। তিনি বলেন, ‘‘লজের একটা জানলার কাচও আস্ত নেই। অনেক টাকা লোকসান হয়ে গেল।’’

simanta maitra gaighata marraige ceremony gaighata miscreants marraige under police protection
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy