Advertisement
০৮ মে ২০২৪

নজরদারি কমিটি তৈরি করে ‘নির্মল’ হচ্ছে বয়রা পঞ্চায়েত

ভোর থাকতেই উঠে পড়ছে ওরা। জামাকাপড়, মাথায় টুপি, গলায় বাঁশি ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ছে মাঠেঘাটে। কেউ খোলা মাঠে শৌচকর্ম করছে না তো? প্রশ্ন একটাই। আর সে দিকেই নজর রাখতে ওরা ঘুরে বেরাচ্ছে মাঠেঘাটে।

চলছে স্কুল পড়ুয়াদের টহল। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

চলছে স্কুল পড়ুয়াদের টহল। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

সীমান্ত মৈত্র
বনগাঁ শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৬ ০৭:৫৩
Share: Save:

ভোর থাকতেই উঠে পড়ছে ওরা। জামাকাপড়, মাথায় টুপি, গলায় বাঁশি ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ছে মাঠেঘাটে। কেউ খোলা মাঠে শৌচকর্ম করছে না তো? প্রশ্ন একটাই। আর সে দিকেই নজর রাখতে ওরা ঘুরে বেরাচ্ছে মাঠেঘাটে।

বাগদার বয়রা পঞ্চায়েত এলাকায় স্কুলের ছেলেমেয়েদের এই উদ্যোগ রীতিমতো সাড়া ফেলেছে এলাকায়। বিডিও মালবিকা খাটুয়ার পরামর্শ মতো স্কুলের ছেলেমেয়ের দল ‘নির্মল পঞ্চায়েত’ হয়ে ওঠার লক্ষে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছে এলাকাকে।

ভোর সাড়ে ৪টে। ঘরের জানলার কাছে তীব্র বাঁশির আওয়াজ। বাঁশির আওয়াজে ঘুম ভাঙল পঞ্চায়েত সদস্যের। ঘুম জড়ানো চোখে জানলা খুলেতেই তিনি দেখলেন, বাঁশি হাতে দাঁড়িয়ে আছে খুদে কয়েকজন স্কুল পড়ুয়াকে। জনপ্রতিনিধিকে দেখেই তারা বলে উঠল, ‘‘ঘুমোলে হবে, আমাদের সঙ্গে যেতে হবে তো!’ অগত্যা কী আর করা। বাধ্য হয়েই দ্রুত তৈরি হয়ে পঞ্চায়েত সদস্য বেরিয়ে পড়লেন ছেলেমেয়েদের সঙ্গে। উদ্দেশ্য, মাঠে-রাস্তার পাশে কেউ মলত্যাগ করলে তাদের ধরা। বছরখানেক আগে শুরু এই কাজের সুফলও মিলেছে। এখন কার্যত কেউ আর খোলা এলাকায় মল-মূত্র ত্যাগ করেন না এই এলাকায়।

বছর খানেক আগেও বয়রা পঞ্চায়েতে এলাকার বহু মানুষ ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে মাঠে-রাস্তার পাশে উন্মুক্ত পরিবেশে মলত্যাগ করতে অভ্যস্ত ছিলেন। এমনকী, এমনও দেখা যেত, যাঁদের বাড়িতে শৌচালয় আছে, তাঁরাও মাঠে মলত্যাগ করতেই পছন্দ করছেন। ফলে দূষণ ছড়াত।

বিডিও মালবিকা খাটুয়ার পরামর্শ মতো, সাধারণ গ্রামবাসীদের ওই প্রবণতা বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন বয়রা পঞ্চায়েতের প্রধান সবিতা বিশ্বাস। তিনি প্রশাসনের পরামর্শ মতো, পঞ্চায়েত এলাকার ২২টি সংসদ এলাকায় ২২টি নজরদারি দল তৈরি করেন। পঞ্চায়েত সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতিটি নজরদারি কমিটির সদস্য পাঁচজন করে। সদস্যেরা সকলেই পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রী। এক একটি কমিটির আলাদা আলাদা নাম দেওয়া হয়েছে। যেমন, ‘প্রফুল্লচন্দ্র রায়’, ‘বিপিনচন্দ্র পাল’, ‘নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু’, ‘রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়’।

কী ভাবে কাজ করে ওই কমিটির সদস্যেরা?

পঞ্চায়েত সূত্রে জানা গিয়েছে, ভোর সাড়ে ৪টেয় ঘুম থেকে উঠে পড়ে সকলে। পঞ্চায়েত থেকে দেওয়া টুপি, বাঁশি, ব্যাজ পরে বেরিয়ে পড়ে এলাকার মাঠে-ঘাটে, রাস্তায়। খুঁজে বের করে, কোথাও কেউ উন্মুক্ত পরিবেশে মল-মুত্র ত্যাগ করছে কিনা। কাউকে ওই অবস্থায় দেখলেই বাঁশি বাজিয়ে সচেতন করার চেষ্টা করা হয়। কাউকে কাউকে ২০০ টাকা করে জরিমানাও করা হয়।

সবিতাদেবী বলেন, ‘‘প্রথম প্রথম কাজটা মোটেই সহজ ছিল না। পড়ুয়ারা নিমরাজি ছিল। বাড়ির লোকেরাও খানিক আপত্তি করতেন। পরে অবশ্য সব ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছে। এখন বিপুল উৎসাহ নিয়ে সকলে কাজ করছে। মাঝে মধ্যেই তারা স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যেকে ঘুম থেকে তুলেও নিয়ে যাচ্ছে।’’

কী ভাবে পড়ুয়াদের মধ্যে উৎসাহ এল?

প্রধান বলেন, ‘‘জরিমানার অর্ধেক টাকা যে কমিটির ধরবে, তাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর তাতেই উৎসাহ বেড়ে যায় সকলের মধ্যে।’’

কাজ শুরু করার পরে কমিটির সদস্যদের নানা হুমকি ও শাসানির সম্মুখীন হতে হয়েছিল বলে জানা গেল। বয়রা পঞ্চায়েতের সচিব মলয়কুমার দত্ত বলেন, ‘‘প্রথমে কেউ মলত্যাগ করতে গিয়ে ধরা পড়লে তিনি কমিটির সদস্যদের ‘দেখে নেওয়া’র হুমকি দিতেন। এমনকী, কমিটির সদস্যদের মাঠের ধান পুড়িয়ে দেওয়ারও হুমকি দেওয়া হতো। খবর পেয়ে আমরা ও ব্লক প্রশাসনের কর্তারা এলাকায় গিয়ে সেই সব মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের বুঝিয়ে সমস্যা মিটিয়েছি। এখন অবশ্য প্রকাশ্যে কেউ মাঠে ঘাটে মলত্যাগ করেন না।’’

পঞ্চায়েত সূত্রে জানা গিয়েছে, বয়রা পঞ্চায়েতে মোট আয়তন ১১.৩২ বর্গ কিলোমিটার। বছরখানেক আগে পরিবারের সংখ্যা ছিল ৭ হাজার ৬৩২টি। প্রধানের দাবি, এখন প্রায় সকলের বাড়িতেই শৌচাগার আছে। বছর খানেক আগে ৮৩৭টি পরিবারে শৌচালয় ছিল না। পঞ্চায়েত ও ব্লক প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়মিত এলাকায় সভা, কর্মশালা করে বাসিন্দাদের বোঝানো হয়, বাড়িতে শৌচাগার তৈরি করার ও খোলা এলাকার মলত্যাগ না করার উপযোগিতা।

পঞ্চায়েত সূত্রের খবর, ‘মিশন নির্মল বাংলা’ প্রকল্পে প্রতিটি পরিবারকে পাকা শৌচাগার তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। ওই প্রকল্পে পাকা শৌচালয় পেতে হলে আবেদনকারীকে দিতে হয় ৯০০ টাকা। বাকি টাকা দেয় প্রশাসন। এক একটি শৌচালয় তৈরি করতে খরচ হয় ১০,৯০০ টাকা। এমন অনেক গ্রামবাসী ছিলেন, যাঁদের ওই সামান্য টাকা দেওয়ারও সামর্থ্য ছিল না। তাঁদের ক্ষেত্রে পঞ্চায়েত ঠিক করে, ওই সব মানুষদের পঞ্চায়েতের নিজস্ব তহবিল থেকে ৯০০ টাকা দেওয়া হবে। এ রকম ৩৫ জনকে টাকা দেওয়া হয়েছে। প্রধানের দাবি, নতুন করে কোনও পরিবার ভেঙে গিয়ে না থাকলে আর কোনও বাড়ি শৌচাগার নেই— এমনটা নয়।

স্থানীয় কুরুলিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, নজরদারি কমিটির সদস্য মিতা মণ্ডল, পুষ্পিতা মণ্ডল, নিরুপমা মণ্ডলরা বাঁশি হাতে বেরিয়ে পড়েছে। মাঠে মাঠে ছুটে বেড়াচ্ছে তারা। তাদের কথায়, ‘‘এখন আর কেউ মাঠে-রাস্তায় মলত্যাগ করেন না। প্রথমে অনেককেই ধরা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ১০০ টাকা করে পাওয়া যা পঞ্চায়েত থেকে। সকলে মিলে তা ভাগ করে নিই।’’

ওই টাকায় কী কর?

লাজুক হেসে ছেলেমেয়েদের জবাব, ‘‘ভাল খাওয়া-দাওয়া করি বন্ধুরা মিলে।’’

বিডিও মালবিকাদেবী বলেন, ‘‘উন্মুক্ত পরিবেশে গ্রামবাসীদের মলত্যাগ বন্ধ করতে বয়রা পঞ্চায়েত দৃষ্টান্তমূলক কাজ করেছে। আমরা ওদের সব সময়ে সাহায্য করি।’’

মলত্যাগ বন্ধের উপরে নজরদারি করা ছাড়াও ওই কমিটির সদস্যেরা এলাকায় জুয়া খেলার উপরেও নজরদারি করে। স্থানীয় কূলনন্দপুরে সকালে জুয়ো খেলা হতো। কমিটির সদস্যেদের নজরে তা আসার পরে প্রশাসন তা বন্ধ করে দিয়েছে।

সব মিলিয়ে আপাতত ‘নির্মল’ স্বপ্নে বিভোর বয়রার মানুষ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Monitoring committee Boyra Panchayet
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE