Advertisement
২০ মে ২০২৪

মাকে খুঁজছে ভাই, কান্না চাপছে দাদা

সাড়ে তিন বছরের সায়নের চেয়ে অনেক বেশি চুপচাপ তার দাদা, আট বছরের সন্দীপ।

মাসি স্বর্ণালী ঘোষের কোলে নরেশ-প্রিয়াঙ্কার ছোট ছেলে সায়ন। বুধবার, দত্তপুকুরে। ছবি: সুদীপ ঘোষ

মাসি স্বর্ণালী ঘোষের কোলে নরেশ-প্রিয়াঙ্কার ছোট ছেলে সায়ন। বুধবার, দত্তপুকুরে। ছবি: সুদীপ ঘোষ

সুনন্দ ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৭ ০২:২৮
Share: Save:

সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকেই মাকে খুঁজে চলেছে সায়ন। না পেয়ে কেঁদে উঠছে মাঝেমধ্যে। বাকি সময়টা অবশ্য ছুটে-খেলেই কাটছে তার।

সাড়ে তিন বছরের সায়নের চেয়ে অনেক বেশি চুপচাপ তার দাদা, আট বছরের সন্দীপ। গত এক সপ্তাহের ঘটনাক্রম সন্দীপের বয়স যেন এক ধাক্কায় বাড়িয়ে দিয়েছে। মাসি আর ভাইয়ের আড়ালে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। এ ভাবে কাঁদতে গিয়ে এক বার ধরাও পড়ে গিয়েছে মাসির কাছে।

মৃত্যু কাকে বলে, তা বোঝার বয়স হয়নি সায়নের। শীতের রোদ্দুর মেখে বুধবার দুপুরে দত্তপুকুরে মাসির বাড়িতে এর-ওর কোলে চেপে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সে। কোনও প্রশ্ন করলে হাসিমুখে উত্তরও দিচ্ছিল। সন্দীপ বাড়ি ছিল না। দাদুর আঙুল ধরে সে চলে গিয়েছিল বাবার মুখাগ্নি করতে। সে জানে, কী করে তা করতে হয়। গত রবিবারই মায়ের মুখাগ্নি করেছে সে।

জগদ্দলের বাসিন্দা, সীমান্তরক্ষী জওয়ান নরেশ পান মারা গিয়েছেন মঙ্গলবার সকালে। শাশুড়ির সঙ্গে গণ্ডগোলের জেরে তাঁর স্ত্রী প্রিয়াঙ্কা গত সপ্তাহের মঙ্গলবার নিজের গায়ে আগুন দেন। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে জখম হন নরেশ। হাসপাতালে প্রিয়াঙ্কা মারা যান শনিবার। নরেশ মঙ্গলবার।

আবার, গত শনিবার প্রিয়াঙ্কার মৃত্যুর খবর পেয়ে দত্তপুকুরের বাড়িতে কীটনাশক খান তাঁর মা শিখা ঘোষ। হাসপাতালের পথে মারা যান তিনিও। একই দিনে মা ও দিদিকে হারানোর পরে দিদির দুই সন্তানকে আঁকড়ে ধরেছেন ২১ বছরের স্বর্ণালী। তাঁর সামনেও অনিশ্চিত এক জীবন। ভূগোলে স্নাতক হয়ে বিএড পড়ছিলেন। ভবিষ্যতের সমস্ত পরিকল্পনা ওলটপালট এক ধাক্কায়।

এ দিন দুপুরে সাইকেল নিয়ে জল আনতে যাচ্ছিলেন স্বর্ণালী। বললেন, ‘‘বিএড-এর একটা সেমেস্টার হয়েছে। চারটে দিতে হবে। জানি না, পারব কি না। সামনে অনেক কাজ। ছেলে দুটোকে এখানকার স্কুলে ভর্তি করাতে হবে।’’ তার পরে? জানেন না স্বর্ণালী।

চাকরির সুবাদে নরেশ বেশির ভাগ সময়ে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী ঘুরে বেড়াতেন। সন্দীপ যখন আরও ছোট, তখন তাকে নিয়ে এবং পরে সন্দীপ-সায়ন দু’জনকে নিয়ে মাঝেমধ্যেই দত্তপুকুরের বাড়িতে এসে থাকতেন প্রিয়াঙ্কা। ফলে সেখানকার উঠোন, তুলসী গাছ, দালান দুই ভাইয়ের বড় চেনা। সঙ্গে দাদু, মাসিও। স্বর্ণালীর কথায়, ‘‘আরও আত্মীয়েরা আছেন। সবাই মিলে ছেলে দুটোকে আগলে রাখছি। কিন্তু, বাকিরা তো চলে যাবেন এক দিন।’’

সায়নকে পাওয়া গেলেও বুধবার দত্তপুকুরে পাওয়া যায়নি সন্দীপকে। স্বর্ণালীর মামাবাড়ি নৈহাটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাকে। বুধবারই ব্যারাকপুরে নরেশের শেষকৃত্যে সন্দীপকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, শেষকৃত্য বৃহস্পতিবার হবে বলে নৈহাটিতেই থেকে গিয়েছে সন্দীপ।

স্বর্ণালী জানিয়েছেন, গত কয়েক বছর ধরে বাড়িতে তুমুল অশান্তি দেখতে দেখতে শক্ত ধাতের হয়ে গিয়েছে তৃতীয় শ্রেণির সন্দীপ। স্বর্ণালীর কথায়, ‘‘শুনেছি, এক বার স্কুলে গিয়ে পড়া পারেনি বলে মিস বকেছিলেন। উত্তরে সন্দীপ বলেছিল, ‘মা কাঁদে। কী করে পড়ব’। মঙ্গলবার দিদি যখন গায়ে আগুন লাগায়, তখন ওরা দু’জনই স্কুলে ছিল। দিদি জামাইবাবুকে হাসপাতালে ভর্তি করার পরে ওরা ছিল ঠাকুরমার কাছে।’’

শনিবার প্রিয়াঙ্কা ও শিখাদেবী মারা যাওয়ার পরে রাতে নরেশদের বাড়ি যান প্রিয়াঙ্কার বাবা নিমাইবাবু। নাতিদের আনতে। কিন্তু নরেশের মা আরতিদেবী আপত্তি করেন। সেই রাতেই জগদ্দল থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয় আরতিদেবী ও তাঁর মেয়ে নিভা সাহার নামে। আরতিদেবীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার পরে রাতে সন্দীপ ও সায়নকে নিয়ে রাখা হয় নৈহাটিতে। রবিবার দুই ছেলেকেই ব্যারাকপুর শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পাশাপাশি শেষকৃত্য হয় প্রিয়াঙ্কা ও শিখাদেবীর।

পাশাপাশি দু’জনের মুখাগ্নি করতে হয় মাসি ও বোনপোকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE