Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Deganga

‘বে-পরোয়া’

বুধবার সকালে দেগঙ্গার হরপুকুর গ্রামে আইএসএফ ও তৃণমূলের মধ্যে সংঘর্ষের পরে পড়ে থাকা কিছু বোমা উদ্ধার করে পুলিশ।

—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

ঋষি চক্রবর্তী
দেগঙ্গা  শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০২৩ ০৭:৩৪
Share: Save:

এ সব এখন গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। আর ভয়-ডর লাগে না। বললেন দেগঙ্গা থানার এক পুলিশকর্মী।

দিন কয়েক আগেই দেগঙ্গার গ্রামে খালি হাতে তাজা বোমা উদ্ধার করে প্রশ্নের মুখে পুলিশের কাণ্ডজ্ঞান। তবে পুলিশকর্মীরা অনেকেই বলছেন, বম্ব স্কোয়াড আর কটা ক্ষেত্রে আসে? বেশির ভাগ সময় তো আমরাই হাতে করে বোমা তুলে জলের বালতিতে চুবিয়ে নিষ্ক্রিয় করি!

বুধবার সকালে দেগঙ্গার হরপুকুর গ্রামে আইএসএফ ও তৃণমূলের মধ্যে সংঘর্ষের পরে পড়ে থাকা কিছু বোমা উদ্ধার করে পুলিশ। দেখা যায়, এক পুলিশকর্মী খালি হাতে বোমা তুলে জলের ড্রামে রাখছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, নিজেদের সুরক্ষার কথাই যদি না ভাবে পুলিশ, তা হলে মানুষের সুরক্ষার বিষয়টি কতটা গুরুত্ব দিয়ে ভাববে তারা!

ভোট ঘোষণার শুরু থেকে রাজ্যের নানা প্রান্তে শুরু হয়েছে বোমা-গুলির লড়াই। মনোনয়ন-পর্বে গিয়ে তা প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন উঠছে, এত আগ্নেয়াস্ত্র আসছে কোথা থেকে? মুখ্যমন্ত্রী বার বার বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশকে পদক্ষেপ করতে বলেছেন। তার পরেও এত অস্ত্র হাতে হাতে ঘুরছে কী ভাবে? বিরোধীদের বক্তব্য, রাজ্যের নানা প্রান্ত কার্যত বারুদের স্তূপের উপরে বসে আছে। নানা ঘটনায় বোঝা যাচ্ছে, কী পরিমাণ অস্ত্র মজুত বাংলার গ্রামে গ্রামে। সেই পরিস্থিতিতে পুলিশকে খালি হাতে বোমা উদ্ধার করতে দেখে মানুষ আরও আতঙ্কিত।

বুধবার হরপুকুরে দেখা গিয়েছে, এক পুলিশ কর্মী কোনও রকম সুরক্ষা ছাড়াই ডান হাত দিয়ে আলতো করে বোমা তুলে জলের ড্রামে রাখছেন। আর এক পুলিশ কর্মী ডান হাত দিয়ে মুখ ঢেকে শরীর উল্টো দিকে নুইয়ে বাম হাত দিয়ে আর একটি বোমা তুলছেন। বোমাগুলি গ্রামের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। পুলিশ কর্মীরা যখন বোমা উদ্ধার করছেন, তখন আশপাশে গ্রামবাসীরাও ছিলেন। প্রশ্ন উঠছে, উদ্ধার করতে গিয়ে বোমা ফাটলে পুলিশ কর্মীদের হাল খারাপ হতে পারত। আশপাশের লোকজনেরও ক্ষতি হতে পারত। একে তো পুলিশ নিজেদের সুরক্ষার কথা ভাবেনি। আশপাশের ভিড় পাতলা করে তাদের সুরক্ষার ব্যবস্থাও করেনি।

এ সব ক্ষেত্রে সচরাচর বম্ব স্কোয়াডকে খবর দেওয়ার কথা। তাঁরা বিশেষ পোশাকে গা-মুখ ঢেকে তবেই বোমা উদ্ধার করেন। পরে সেগুলি প্রত্যন্ত কোনও এলাকায় নিয়ে গিয়ে নিষ্ক্রিয় করা হয়। সেখানে দমকলেরও উপস্থিত থাকার কথা। বুধবার এ ধরনের কোনও নিয়মই মানা হয়নি বলে জানাচ্ছেন গ্রামের মানুষ।

জেলা পুলিশ কর্তারা কেউ বিষয়টি নিয়ে সরাসরি মন্তব্য করেননি। বারাসত পুলিশ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিশ্বচাঁদ ঠাকুর বলেন, "দেগঙ্গায় একটা ঘটনা ঘটেছিল। পুলিশ দু’জনকে গ্রেফতার করেছে। কিছু বোমা উদ্ধার হয়েছে। নিয়ম মেনে উদ্ধার করা হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে।"

দেগঙ্গা, আমডাঙা থানার পুলিশের অনেকেই জানালেন, খালি হাতে বোমা আকছার কুড়োতে হয় তাঁদের। পুলিশ সূত্রের দাবি, উত্তর ২৪ পরগনাকে ভেঙে বিধাননগর ও ব্যারাকপুর দু’টি পৃথক পুলিশ কমিশনারেট এবং বারাসত, বনগাঁ ও বসিরহাট পুলিশ জেলা করা হয়েছে। তবে সেই অনুপাতে পরিকাঠামো তৈরি হয়নি। বারাসত পুলিশ জেলার দোলতলা পুলিশ লাইনে বম্ব স্কোয়াড আছে। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, জনা পঞ্চাশ কর্মী আছেন সেখানে। জেলার নানা প্রান্তে ছুটতে হয় তাঁদেরই। তবে প্রাথমিক ভাবে পুলিশকেই বোমা উদ্ধার করে সুরক্ষিত স্থানে রাখতে হয়। পরে সেগুলিকে নিষ্ক্রিয় করতে আবেদন করতে হয়। একাধিক পুলিশ কর্তাদের টেবিল ঘুরে অনুমোদন পেলে কলকাতা, দোলতলা বা ব্যারাকপুর থেকে বম্ব স্কোয়াডের লোকজন সংশ্লিষ্ট থানা এলাকার ফাঁকা জায়গায় নিয়ে গিয়ে বোমা নিষ্ক্রিয় করেন।

জেলা পুলিশের এক আধিকারিকের যুক্তি, প্রতি থানায় বোমা উদ্ধার করার কৌশলপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মী থাকেন। তাঁরাই বোমা উদ্ধারকরেন। তা ছাড়া, পুলিশের কাজে সব সময়ে ঝুঁকি থাকে। দেগঙ্গার ঘটনার প্রেক্ষিতে অনেকের পুরনো একটি অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ছে। বছর কয়েক আগে মাওবাদী আন্দোলনের সময়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের ঝিটকার জঙ্গলে হাতে করে কৌটো বোমা উদ্ধার করতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছিল পুলিশ কর্মীর। জখম হন সংবাদমাধ্যমের কর্মীরাও।

দেগঙ্গার গ্রামে এত বোমা-গুলি আসছে কোথা থেকে, সে প্রশ্নও উঠছে। বুধবারের ঘটনায় দেগঙ্গার মানুষের আরও বক্তব্য, গোলমাল বেধেছিল আইএসএফের পতাকা লাগানোকে কেন্দ্র করে। সামান্য পতাকা বাঁধার ঘটনাতেই যদি এমন মুড়ি-মুড়কির মতো বোমা ফাটে, গুলি চলে— তা হলে ভোটের দিন কী ঘটতে পারে, তা ভেবে এখনই শিউরে উঠছেন অনেকে। মুখ্যমন্ত্রী বার বার বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের কথা বললেও আদতে কতটা কাজ হয়েছে, সে প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে কিছু বোমা-গুলি উদ্ধার হলেও তা যে যথেষ্ট নয়— নানা ঘটনায় প্রমাণ মিলছে তার। ক’দিন আগে ভাঙড়ের গ্রামেও আইএসএফ এবং তৃণমূলের মধ্যে সংঘর্ষে প্রচুর বোমা পড়ে, গুলি চলে। ওই ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন দু’পক্ষের তিন জন।

আইএসএফের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক কুতুবউদ্দিন ফতেহি বলেন, "তৃণমূল বোমা-বন্দুক নিয়ে, দুষ্কৃতীদের সঙ্গে করে গোলমাল চালাচ্ছে। অস্ত্রশস্ত্র ওদের হাতে প্রচুর। পুলিশ সে সব উদ্ধার করতে ভোটটা শান্তিতে হতে পারত।" বিজেপির বারাসত সাংগঠনিক জেলার সহ সভাপতি তুহিন মণ্ডলের কথায়, "বারুদের উপরে দাঁড়িয়ে আছে গোটা দেগঙ্গা ব্লক। একটা পাড়ায় যদি মুড়িমুড়কির মতো এত বোমা পড়ে, তা হলে পুরো ব্লকে কত বোমা মজুত আছে, সেটা কি পুলিশ কর্তারা বুঝতে পারছেন?’’ হাড়োয়ার বিধায়ক নুরুল ইসলাম বলেন, "গোলমালের ঘটনায় পুলিশ তদন্ত করছে। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে পুলিশ। শান্তিপূর্ণ নির্বাচনই আমাদের কাম্য।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Deganga Bomb Threat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE