Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

মূল জীবিকা মাছ চাষ, তবু সংরক্ষণ নিয়ে দাবি মিটল না ব্যবসায়ীদের

গত কয়েক দশকে বদলেছে অনেক কিছুই। জঙ্গল কেটে বসতি হয়েছে। মাটির বাড়ির পরিবর্তে বড় বড় উঁচু পাকা বাড়ি মাথা তুলেছে। দোকানপাট, অফিস, সেতু তৈরি হয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়া মত বদলে গিয়েছে হাড়োয়া। মূল জীবিকা কৃষি ছেড়ে শুরু হয়েছে মাছের চাষ। সুন্দরী, হেতাল, গরান, গেঁওয়া, গাছের ঝোপ সাফ করে সেখানে খাল কেটে ঢোকানো হয়েছে বিদ্যাধরীর নোনা জল।

মাছ বাজারের হালও শুধরোয়নি। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।

মাছ বাজারের হালও শুধরোয়নি। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।

নির্মল বসু
হাড়োয়া শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৫ ০০:৫৬
Share: Save:

গত কয়েক দশকে বদলেছে অনেক কিছুই। জঙ্গল কেটে বসতি হয়েছে। মাটির বাড়ির পরিবর্তে বড় বড় উঁচু পাকা বাড়ি মাথা তুলেছে। দোকানপাট, অফিস, সেতু তৈরি হয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়া মত বদলে গিয়েছে হাড়োয়া। মূল জীবিকা কৃষি ছেড়ে শুরু হয়েছে মাছের চাষ। সুন্দরী, হেতাল, গরান, গেঁওয়া, গাছের ঝোপ সাফ করে সেখানে খাল কেটে ঢোকানো হয়েছে বিদ্যাধরীর নোনা জল। তবে যারা একদিন বাদাবন কেটে, জলদস্যুদের তাড়িয়ে বসতি স্থাপন করেছিল, জমিদারদের লেঠেল বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে রক্ত ঝরিয়ে জমি ছিনিয়ে নিয়ে ভেবেছিল চাষযোগ্য করবে, সেই আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষগুলোর জীবনে বিশেষ কোনও পরিবর্তন আসেনি।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, প্রথমে জমিদারদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া জমিতে ধান ও মাছ চাষ হলে ধীরে ধীরে সেখানে ধান চাষ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে কেবল বাগদা ও রুই-কাতলা-তেলাপিয়া-ট্যাংরা, ভেটকি মাছের চাষ শুরু হয়। তাতে আখেরে গরিব কৃষকেরা লাভবান হননি বললেই চলে। কোনও না কোনও রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় থাকা বিত্তবান মানুষজন জমি মালিকদের হাতে সামান্য কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে মাছে চাষের লভ্যাংশের বেশির ভাগটাই নিজেদের পকেটে ভরতে থাকে। হাড়োয়ায় আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা বলতে রানিগাছি, চারাবাড়ি, খেজুরতলা, গাবতলা, তেঁতুলতলা, সুভাষপল্লি এবং দিগাছি এলাকাকে বোঝায়। জানকি লোহার, কমলমনি লোহার, অঞ্জলি সর্দাররা বলেন, ‘‘আমাদের পূর্বপুরুষেরা এক সময়ে জঙ্গল কেটে বাস করতে শুরু করেছিলেন এখানে। অথচ আমাদের অনেকেই বিপিএল তালিকাভুক্ত না হওয়ায় সরকারি প্রকল্পের সাহায্য থেকে বঞ্চিত। ইটভাটা আর মেছোভেড়িতে কাজ করে রোজগার যা হয়, তাতে সংসার চলে না বলে ঘরের পুরুষদের বেশিরভাগকে ছুটতে হয় ভিনরাজ্যে। আমাদের জন্য শিক্ষা-স্বাস্থ্য বা বাসস্থানের কোনও বিশেষ সুবিধাই নেই।’’ কমল মাহাত, খগেন দলুই, পরিতোষ সর্দাররা বলেন, ‘‘এক সময়ে যাদের কথায় লাঠি ধরে জমিদারদের সঙ্গে লড়াই করে ধান চাষ করব বলে জমি ছিনিয়ে নিয়েছিলাম, এখন তাদের অনেকেই চাষের জমিতে নোনা জল ঢুকিয়ে মাছের ব্যবসা করে কোটিপতি। আর আমাদের দু’বেলা দু’মুঠো ভাত জোগাড় করতে কপালের ঘাম পায়ে পড়ে। যাদের সামান্য জমি আছে, তা-ও হাজার বিঘা জলকরে মধ্যে। ধান কিংবা সব্জিচাষের উপায় নেই। বাবুরা যেটুকু টাকা দেন, তাই হাত পেতে নিতে বাধ্য সকলে।’’

এক সময়ে নৌকা ভর্তি হয়ে সুন্দরবন এলাকা থেকে আসা ধান রাখার জন্য বিদ্যাধরীর তীরে বড় বড় গুদাম ঘর ছিল। এই এলাকা থেকে যাওয়া ধান কলকাতা-সহ রাজ্যের মানুষের কাছে পৌঁছে যেত। বর্তমানে ধানের গুদাম প্রায় নিশ্চিহ্ন। এখন ধানের পরিবর্তে হাড়োয়া এলাকার মূলত বাগদা চিংড়ি দেশ-বিদেশের বাজারে চড়া দামে বিকোচ্ছে। তবে ধান মজুতের জন্য যেমন গুদাম ছিল, তেমনি মাছ সংরক্ষণের কোনও সরকারি ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ধান চাষের জমি রূপান্তরিত হয়েছে মেছোভেড়িতে। ‘প্যাডি কাম ফিসারি’র জন্ম ১৯৬০-৬১ সালে। পরবর্তিতে সেই ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে পাকাপাকি ভাবে হাজার হাজার বিঘা জমি মেছোভেড়িতে পরিণত হয়।

কমবেশি ৮০ হাজার বিঘা জমিতে ছোট-বড় দেড় হাজারের উপর ফিসারি আছে। প্রায় দেড় লক্ষ মানুষের অধিকাংশই কোনও না কোনও ভাবে মাছের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। বছরে একশো কোটি টাকার বেশি মাছ বিক্রি হয় এখান থেকে। নজরুল মোল্লা, সঞ্জু বিশ্বাস, আব্দুল নঈম মোল্লা, কাসেদ মোল্লারা বলেন, ‘‘ভাইরাস জনিত কারণে চিংড়ি মাছের উৎপাদন কমেছে। অনেক খেত্রে আড়তদারেরা সময় মতো টাকা দিতে না পারায় চাষের ক্ষতি হয়। তা ছাড়া, বেশি পরিমাণ মাছ বাজারে উঠলে ন্যায্য মূল্য পাওয়া যায় না। সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় যে দাম বলা হয়, তাতেই বিক্রি করতে হয়।’’

মাছকে কেন্দ্র করে যেখানে প্রতিদিন কোটি টাকার লেনদেন হয়, সেখানকার পরিবেশের তেমন উন্নতি চোখে পড়ে না। একটু বৃষ্টি হলেই নর্দমার জলে ভরে যায় মাছের বাজার। মোমিনুল ইসলাম, প্রবীর পাল বলেন, ‘‘আড়তগুলির আধুনিকীকরণ, নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতি এবং সরকারি ভাবে মাছ রাখার হিমঘর হলে ভাল।’’

হাড়োয়া মৎস্য বাজার কমিটির সম্পাদক জাহাঙ্গির আলম বলেন, ‘‘বাজার কমিটির পক্ষ থেকে বাজারের মধ্যে রাস্তা করা হয়েছে। নালা পরিষ্কারের জন্য বিধায়কের পক্ষ থেকে ৪ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে।’’

স্থানীয় বিধায়ক জুলফিকার আলি মোল্লা বলেন, ‘‘এলাকার পরিবেশের উন্নতিতে বিদ্যাধরী নদীর ধার বরাবর প্রায় দু’কিলোমিটার রাস্তা এবং পার্ক গড়ে তোলার কাজ শুরু হচ্ছে। নদী বাঁধ, আইটিআই কলেজ, কংক্রিটের রাস্তা, পড়ুয়াদের হস্টেল, আর্সেনিক-মুক্ত পানীয় জলের ব্যবস্থা হয়েছে। মাছ বাজারের সামনের নালা পরিষ্কারের জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়েছে।’’ কলকাতা-সহ বিভিন্ন এলাকায় মাছ দ্রুত চলে যায় বলে সংরক্ষণের তেমন প্রয়োজন পড়ে না বলেই তাঁর মত। তা সত্ত্বেও সকলের কথা ভেবে মাছ সংরক্ষণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জুলফিকার।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE