হোমের মানে বদলে গিয়েছে ওদের কাছে। আর বদলে গিয়েছে ওরাও।
এর পিছনে রয়েছে বদলে দেওয়ার ইচ্ছে, সহমর্মিতা আর কিছু কৌশল। এই পরিবর্তন এসেছে ৬ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত শিশু-কিশোরদের রাখার সরকারি আবাসিক হোম, কিশলয়ে।
কিছু দিন আগে পর্যন্ত বারাসতের কিশলয় হোম থেকে পালানোর ঘটনা লেগেই থাকত। কিন্তু এখন হোম থেকে শিশু-কিশোরদের পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা কমে গিয়েছে। হারিয়ে গিয়ে যারা হোমে আসছে, পরিবারের খোঁজ করে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের।
আর যে সব কিশোরেরা কোনও অপরাধে জড়িয়ে পড়ে হোমে আসছে, সংশোধন করে পরিবারকে বুঝিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদেরও। অদ্ভুত ভাবে ঘটে গিয়েছে এমন পরিবর্তন।
কী ভাবে এমন অসম্ভব সম্ভব হল?
কয়েক বছর আগের ঘটনা। কিশলয় হোম থেকে পরপর আবাসিক পালানোর পরে বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসে রাজ্য সরকার ও সমাজ কল্যাণ দফতর। শুরু হয় ওই হোমের উপর নজরদারি। সুপারিটেনডেন্ট বদল থেকে শুরু হয় ঘর বাড়ি সারানোর কাজ। খাবারের মানেরও পরিবর্তন হয়। আগে ছেলে পিছু প্রতিদিন বরাদ্দ ছিল অতি সামান্য, তা বাড়ানো হয়। শিশু সুরক্ষা কমিটিকেও দেওয়া হয় হোমের বাড়তি দায়িত্ব।
এ তো গেল প্রশাসনিক ও পরিকাঠামো বদলের কথা। কিন্তু ওই হোমের শিশুরা কেন পালাচ্ছে তা নিয়ে শুরু হয় খোঁজখবর।
দেখা যায়, জেলখানার মতো ছোট ছোট ঘরে বন্দি থাকতে চায় না ছেলেরা। হোম পালানো একটি ছেলেকে ধরে আনার পরে জানা যায়, অনেকদিন ট্রেন চড়েনি বলে
এ ক’দিন ট্রেনে-ট্রেনে ঘুরে বেড়িয়েছে সে।
এর পরে যারা ট্রেনে চড়তে ভালবাসে, বিশেষ নজরদারিতে তাদের ট্রেনে চড়ানো হয়। যারা মাঠে ফুটবল, ক্রিকেট খেলতে ভালবাসে, আস্তে আস্তে মাঠে ছাড়া হয় তাদের। বলা হয়, অলক্ষ্যে এমন নজরদারি রয়েছে যে কেউ পালাতে পারবে না। তার পরেও যদি কেউ পালানোর চেষ্টা করে তা হলে তাকে আর বাইরে যেতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। কাজ হয় এমন টোটকাতেও।
পশ্চিমবঙ্গ শিশু অধিকার সুরক্ষা আয়োগের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তী জানিয়েছেন, ছেলেদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। নতুন ঘর হয়েছে। ছবি আঁকা শিখে হোমের ছেলেরাই সেখানে দেওয়ালে রং করে সাজায় তাদের মনের মতো। সবুজের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নাটক (গাছ) করেছে এক দল। হোমের ভিতরের বাগানে ফুল, ফলের গাছ পুঁতে সাজিয়েছে তারাই।
‘স্বচ্ছ ভারত মিশনে’ অংশ নিয়ে প্রশিক্ষণ পেয়ে হোমের ভিতর পরিষ্কার রাখতে বদ্ধপরিকর ছেলেরা। আগের সেই নোংরা উধাও। নিজেদের তৈরি পুতুল দিয়ে চলছে পুতুলনাচ। বিষয়, ‘নীতি কথা’, ‘মিথ্যা কথা বলার সাজা’, ‘চোরের পরিণতি,’ ইত্যাদি। এ সব কাজে যারা ব্যস্ত, অন্য ছেলেরা তাদের হাতে দিয়ে যাচ্ছে গরম গরম পকোড়া। রান্নার প্রশিক্ষণও নিয়েছে এরা।
হোমের টাকা তছরুপ করে খারাপ মানের খাবার দেওয়ার অভিযোগ আগে উঠেছে। গত ১০ বছর ধরে ওই হোমে রয়েছে, এমন এক আবাসিকের কথায়, ‘‘আগে খাবারের মান ছিল খুব খারাপ। এখন বাড়ির মতোই।’’
কিশলয় হোমের সুপার মলয় চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘হোম নিয়ে প্রচারের পরে অনেক সহৃদয় ব্যক্তি মাঝেমধ্যে হোমে এসে ছেলেদের ‘ট্রিট’ দেন। সে দিনের বেঁচে যাওয়া টাকায় কখনও ফ্রায়েড রাইস, কখনও বিরিয়ানি খাওয়া হয়। বাড়ির মতোই সকলের ভালবাসা পাচ্ছে ওরা। ছেলেরা তাই এখন হোম ছেড়ে যেতে চায় না।’’
উত্তর ২৪ পরগনার শিশুসুরক্ষা কমিটির চেয়ারপার্সন অরবিন্দ দাশগুপ্ত জানিয়েছেন, ২০১৬ সালে এক বছরেই ২২৬টি শিশু ও কিশোর এসেছিল কিশলয়ে। তাদের মধ্যে ২২৩ জনকেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে পরিবারের কাছে।
এর মধ্যে হারিয়ে যাওয়া শিশু যেমন রয়েছে, তেমনই অপরাধে জড়িয়ে পড়া কিশোরেরাও রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে এ দেশে আসা শিশু কিশোরদের ফিরিয়ে দেওয়াও হয়েছে। এখন ১৪৩ জন আবাসিক রয়েছে কিশলয়ে। এর মধ্যে বেশিরভাগই ঠিকানা ভুলে বছরের পর বছর ধরে হোমে পড়ে রয়েছে। কেউ কেউ হোমে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজও পেয়েছে।
হোম কর্তৃপক্ষ, অতিরিক্ত জেলাশাসক (রাজস্ব) এবং শিশু সুরক্ষা কমিটিকে এর জন্য কৃতিত্ব দিয়ে জেলাশাসক অন্তরা আচার্য বলেন, ‘‘সকলের চেষ্টাতেই এটা সফল হয়েছে। ছেলেরা পুরস্কার পাচ্ছে। ওদের জন্য আরও চিত্তাকর্ষক কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে।’’
এক সময়ে এই হোমের আবাসিকরাই পালাতে না পেরে নিজের হাতের শিরা কেটে রক্তাক্ত হয়েছিল। মানবাধিকার কমিশন পর্যবেক্ষণে এলে হোমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে শরীর ক্ষতবিক্ষত করেছিল আবাসিকেরা।
আর এখন?
এ বারের ২৬ জানুয়ারি, প্রজাতন্ত্র দিবসে কাছারি মাঠে গোটা উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সমস্ত স্কুলকে হারিয়ে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় সেরা হয়েছে কিশলয়ের ছেলেরাই। কুচকাওয়াজেও দ্বিতীয়ও হয়েছে তারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy