বনগাঁ-চাকদহ রোডে কালসোনা এলাকায় রাস্তা দখল করে ইমারতি দ্রব্য। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
কোথাও সড়কের মাঝখানে বালির পাহাড়। কোথাও প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে ছড়িয়ে পাথরকুচি। সড়কের পাশে সার দিয়ে সাজানো ইটের পাঁজাও চোখে পড়ে হামেশাই। আর তারই ফাঁক দিয়ে কোনওরকমে চলছে যানবাহন। গোটা বনগাঁ মহকুমার বেশিরভাগ সড়কেই বলতে গেলে ইমারতি ব্যবসায়ীদের দাপট। বনগাঁবাসীর অনেকেই তাই কৌতুক করে বলেন, ‘‘ যদি কেউ প্রশ্ন করে, ‘সড়ক তুমি কার? উত্তর আসবে আমি ইট, বালি, পাথর, সুরকির। গাড়িঘোড়ার নয়।’’
মহকুমার দু’টি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, বনগাঁ-চাকদহ এবং বনগাঁ-বাগদা। দু’টি সড়কেই দিনের পর দিন বেআইনিভাবে ফেলে রাখা হয় ইমারতির জিনিস। ফলে অপরিসর রাস্তায় চলতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনায় পড়ে যানবাহন। প্রাণহানিও ঘটে অহরহ। অবশ্য এসবে কোনও হেলদোল নেই পুলিশ বা প্রশাসনের, এমনই অভিযোগ বাসিন্দাদের। সব দেখেশুনেও চুপ থাকেন রাজনৈতিক দলের নেতারাও।
সম্প্রতি বনগাঁ শহরের মধ্যে রামনগর রোডে বাঁধানো বটতলা এলাকায় ট্রাক চাপা পড়ে মৃত্যু হয় বিনয় অধিকারী নামে এক বৃদ্ধের। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, তাঁকে পিছন থেকে একটি ট্রাক ধাক্কা মারলে তিনি রাস্তায় রাখা পাথরকুচির স্তূপের উপর গিয়ে পড়েন। সেখান থেকে পিছলে ফের রাস্তায় পড়তেই ট্রাকের চাকা তাঁকে পিষে দেয়। এরকম দুর্ঘটনা ওই রাস্তায় প্রায়ই ঘটে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, একাধিকবার সড়ক থেকে ওই সব ইমারতির জিনিস সরানোর দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। দ্বারস্থ হয়েছেন পুলিশ থেকে স্থানীয় বিধায়ক, রাজনৈতিক নেতা সকলের। নিরুপায় হয়ে পথ অবরোধ করে বিক্ষোভও দেখিয়েছেন। সেই সময় প্রতিশ্রুতি পেলেও তা আর কাজে পরিণত হয়নি। উল্টে অনেক ক্ষেত্রেই শুনতে হয়েছে, ‘সড়ক সংস্কারের কাজ করার জন্যই ওই ইমারতি মালপত্র রাখা হয়েছে’র যুক্তি।
মহকুমার অন্য দুই গুরুত্বপূর্ণ সড়কেরও একই ছবি। শহরের ত্রিকোণ পার্ক এলাকায় বনগাঁ-চাকদহ সড়কে বেআইনিভাবে ফেলে রাখা হয় পাথরকুচি, বালি, ইট। এখানেও শুনতে হয়েছে, পাশেই সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তৈরির জন্যই রাখা হয়েছে ওই সব ইমারতি মালপত্র। যদিও যান চলাচলের অসুবিধা, দুর্ঘটনার আশঙ্কা সত্ত্বেও কেন রাখা হয়েছে সে সব, তার কোনও উত্তর মেলেনি পুলিশ-প্রশাসন কারও কাছেই।
ওই সড়ক ধরে চাকদহের দিকে যেতে গিয়ে দেখা গেল কালীবাড়ি মোড়ের কাছে, চাপাবেড়িয়া, পলতা, সাতবেড়িয়া গোপালনগরের ব্যারাকপুর মোড়, দাড়িঘাটা সেতু বা গোপালনগর বাজার, কানসোনা এলাকায় ফেলে রাখা হয়েছে বালি, পাথরকুচি, খোয়ার স্তূপ। গোপালনগর বাজার এলাকায় ঢুকতেই দেখা গেল নির্মাণ কাজের জন্য রাস্তার উপরেই বালি-খোয়া মাখা হচ্ছে। সড়কের মাঝখান পর্যন্ত ফেলে রাখা হয়েছে খোয়া। রাস্তা জুড়ে রয়েছে গাছের গুঁড়ি। বনগাঁ-বাগদা সড়কের চাঁদা বাজার, রায়পুর, চাঁদা টালিখোলা মাঠ এলাকারও একই ছবি। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, মূলত ইমারতির দোকানদারেরাই ওই সব ইট বালি খোয়া রাখেন। এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে বাসিন্দাদেরও। চাঁদা এলাকার এক যুবক বলেন (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক), ‘‘ইমারতি কারবারিদের ওসব সরাতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা গ্রাহ্যই করেননি। এলাকারই ছেলেরা ওই সব ফেলে রেখেছে রাস্তায়। ওদের আবার এলাকার নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে। ওরা এতটাই বেপরোয়া, কে কী বলবে?।’’
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মহকুমা পুলিশ প্রশাসন মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, বেআইনিভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাক কিংবা ইমারতি দ্রবের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা নিলে কেউ কোনও সুপারিশ করতে পারবেন না। কিন্তু সে সবের কোনও সুফল দেখতে পাননি বাসিন্দারা।
বছর পাঁচেক আগে সরু ও বেহাল বনগাঁ-চাকদহ সড়ক সম্প্রসারণ করা হয়েছিল। ১০ মিটার চওড়া রাস্তা এখন ঝাঁ চকচকে। বনগাঁ শহর এবং গোপালনগরের বহু মানুষ সড়ক পথে যশোহর রোডের যানজট এড়াতে ওই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করেন। রাস্তা চওড়া হওয়ায় এলাকার মানুষ খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু এখন তাঁরা হতাশ। তাঁদের অভিযোগ, বেআইনিভাবে ওই সড়কে ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকে। কোনও কোনও সময় সড়কের দু’ধার জুড়েই ট্রাক থাকে। তার ওপর ইমারতি মালপত্র যত্রতত্র পড়ে থাকে। গত কয়েক বছরে এই কারণে ওই সড়কে দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন অনেকে। জখমের সংখ্যার হিসেব নেই। সাময়িকভাবে কখনও নড়ে চড়ে বসে প্রশাসনের কর্তারা। কিন্তু কয়েক দিন যেতে না যেতেই ফের ফিরে আসে আগের ছবি। বাসিন্দারা জানান, পুলিশ-প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নেয় না বলেই ইমারতির কারবারিরা এতটা বেপরোয়া। আবার কখনও পুলিশ তৎপর হলেও তা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় না। এ বিষয়ে পুলিশের একাংশের দাবি, রাস্তা থেকে ইমারতির জিনিস সরাতে তাঁরা তৎপর হলেও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ফোন এলে বাজেয়াপ্ত মালপত্র ছেড়ে দিতে হয়। যদিও স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস বলেন, ‘‘অতীতে বহু বার পুলিশ প্রশাসনকে বলেছি সড়ক থেকে ট্রাক ও ইমারতি মালপত্র সরাতে। প্রয়োজনে ফের বলব।’’
সড়কের ধারে ইমারতির জিনিস রাখা নিয়ে বনগাঁর এসডিপিও বিশ্বজিৎ মাহাতো বলেন, ‘‘ত্রিকোণ পার্ক এলাকায় সড়ক থেকে ইমারতি মালপত্র সরিয়ে নিতে বলেছি। অন্য এলাকাতেও সড়কে ইমারতি মালপত্র পড়ে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ স্থানীয় পুর প্রশাসন ও পঞ্চায়েতের সঙ্গে কথা বলে ওই বিষয়ে পদক্ষেপ করা হবে বলে জানিয়েছেন মহকুমাশাসক সুদীপ মুখোপাধ্যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy