Advertisement
E-Paper

স্থাপত্য আর নদী টানে ক্যামেরাকে

হালিশহরের আলোকচিত্রের ঐতিহ্য খুঁজতে ফিরে যেতে হবে স্বাধীনতারও আগের সময়ে। অনেকেই শৌখিন ভাবে ছবি তুলতেন। ব্যক্তিগত সংগ্রহের বহু নমুনা যার সাক্ষী। শহরের বনেদি পরিবার পালিত বাড়ির জামাই বঙ্কুবিহারী বসুর ১৯৫৬ সালে তোলা স্থানীয় ডানলপ ঘাটে সূর্যাস্তের একটি ছবি সে সময়ে বিদেশেও প্রশংসিত হয়। ইংল্যান্ড থেকে ‘নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ছবি’ হিসাবে সেরা পুরস্কার জিতে আনে বঙ্কুবাবুর সেই ছবি।

বিতান ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০১৫ ০১:৫৮
হালিশহরের আলোকচিত্রীদের বরাবরই আকর্ষণ করেছে গঙ্গা। (ছবি, দ্বিমাত্রিক ফটোগ্রাফি ক্লাবের সৌজন্যে)।

হালিশহরের আলোকচিত্রীদের বরাবরই আকর্ষণ করেছে গঙ্গা। (ছবি, দ্বিমাত্রিক ফটোগ্রাফি ক্লাবের সৌজন্যে)।

হালিশহরের আলোকচিত্রের ঐতিহ্য খুঁজতে ফিরে যেতে হবে স্বাধীনতারও আগের সময়ে। অনেকেই শৌখিন ভাবে ছবি তুলতেন। ব্যক্তিগত সংগ্রহের বহু নমুনা যার সাক্ষী।

শহরের বনেদি পরিবার পালিত বাড়ির জামাই বঙ্কুবিহারী বসুর ১৯৫৬ সালে তোলা স্থানীয় ডানলপ ঘাটে সূর্যাস্তের একটি ছবি সে সময়ে বিদেশেও প্রশংসিত হয়। ইংল্যান্ড থেকে ‘নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ছবি’ হিসাবে সেরা পুরস্কার জিতে আনে বঙ্কুবাবুর সেই ছবি। ক্লিক-৩, আইসলি আগফা’র সাদা-কালো ষোলো-এমএম ফিল্ম রোলের যুগে হালিশহরে রামপ্রসাদের ভিটে, বারেন্দ্র গলির শিব মন্দির, চৈতন্য ডোবা, রাসমণির বাড়ি, সিদ্ধেশ্বরী ঘাট, ডানলপ ঘাটের ছবি তুলেছিলেন সেই আমলের বহু শখের আলোকচিত্রী।

এক সময়ে হাভেলিশহরের (হালিশহরের প্রাচীন নাম) প্রাচীন স্থাপত্য আর গঙ্গা পাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই বোধহয় ছবি তোলার আগ্রহ তৈরি করত এই শহরের মধ্যবিত্তের মনে। সব আলোকচিত্রীদেরই পুরনো ছবির সংগ্রহে এই ছবিগুলি আছে। ছবি তোলার নেশা থেকেই পেশা হিসাবে স্টুডিও খোলার কথা ভেবেছিলেন অনেকে। তা না হলে গোটা শিল্পাঞ্চলে অন্য শহরগুলি যখন সে কথা ভাবতেই পারেনি, তখন শহর কলকাতা থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরের এই হালিশহরে রমরমিয়ে চলত গৌরী আর্ট স্টুডিও, অপ্সরা, রাখী স্টুডিও, আলোছায়া, আর্ট স্টুডিও, বর্ণালী, চিত্রণের মতো অসংখ্য স্টুডিও। এখনও এই শহরে ২২টি স্টুডিও। ছবি তোলার ঝকমারি সে যুগে অনেক বেশি ছিল। মফস‌্সলের এই আলোকচিত্রীদের সেই অর্থে তালিম দেওয়ার কেউ ছিল না। কিন্তু নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়েই ছবি তোলার শিল্প আয়ত্ত করেছিলেন এই শহরের মানুষ।

হাতে হাতে ঘোরা ডিজিটাল ক্যামেরার যুগে বসে সে দিনের ছবি তোলার সমস্যার কথা গল্পের মতে মনে হবে। এক্সপোজারে ভুল করলে শোধরানোর উপায় থাকত না। প্রিন্টের উপরে রঙ-তুলির প্রলেপ দিতে হতো অনেক সময়ে। বড়, ভারি ক্যামেরা নিয়ে এ দিক ও দিকে যাওয়া মুশকিল ছিল। স্টুডিও ফটোগ্রাফার মানে তখন চিত্রশিল্পীও। আর্ট স্টুডিওগুলিতে ছবি তোলার আগে ছবি আঁকার চল ছিল। শ্মশানে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার আগে দেহ ঘিরে পরিবারের সকলের ছবি আর মৃতের পায়ের ছাপের ছবি তুলে রাখাটা এক রকম সামাজিক প্রথায় পরিণত হয়েছিল। শ্মশানের কাজের জন্য অবশ্য আলাদা পেশাদার ফটোগ্রাফার থাকতেন।

সাধারণত কম আয়ের স্টুডিওগুলি রাত জেগেও ‘শ্মশান-ফটোগ্রাফি’ করত ব্যবসা টিঁকিয়ে রাখার তাগিদে। বিয়ে বাড়ির ছবি তোলা মানে আলোকচিত্রীদের দীর্ঘ দিনের আয়ের জোগান।

বিয়ের ছবিতে তখন অন্য রকম সম্মানও ছিল। ফটোগ্রাফারকে আলাদা করে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকত এক সময়ে। স্টুডিও অপ্সরার মালিক প্রবীণ আলোকচিত্রী কাশীনাথ কোলে বলেন, ‘‘বিয়ের পরে বিদায়ের সময়ে চোখের জলে পাত্রী যখন হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন অন্য কারও কথা না শুনলেও ফটোগ্রাফারের কথায় ছবির জন্য কষ্ট করেও হাসি মুখ করতেন। বড় বাড়ির অন্নপ্রাশনে ঘুমিয়ে পড়া খোকাকেও জাগিয়ে তুলে সকলে মিলে হাসি হাসি মুখে ছবি তোলাতেন। তবে সে সব দিন আর নেই। এখন তো মোবাইলেই ৩৫ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা। ছবির পর ছবি উঠে যাচ্ছে বাড়ির লোকেদের দিয়েই।’’ চিত্রণ স্টুডিওর মালিক প্রবীণ আলোকচিত্রী সুবীর বিশ্বাস বলেন, ‘‘এখন তো স্টেশনারি দোকানেও পাঁচ মিনিটে ছবি তুলে প্রিন্ট করে দেওয়া হয়। আমাদের এখানেও ফটোকপির দোকানে সঙ্গে সঙ্গে রঙিন ছবি প্রিন্ট করা হয়। আমরা আর কী করে ব্যবসা থেকে লাভ করব?’’


রানি রাসমণির দেওয়ান ছিলেন চন্দ্রকান্ত পালিত। তাঁর জামাই বঙ্কুবিহারী বসুর তোলা
এই ছবিটিই বিলেতে পুরস্কৃত হয়েছিল। (পারিবারিক সংগ্রহ থেকে)

ডিজিটাল ফটোগ্রাফি আসার পরে স্টুডিও ব্যবসার ধরন বদলেছে। সরস্বতী পুজোয় লাইন দিয়ে ছবি তুলতে যাওয়া বা জন্মদিনের ছবি তোলা, পারিবারিক অ্যালবাম করার ভিড় আর নেই। কিন্তু প্রোফাইল বানানো, বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও বিয়েতে রীতিমতো সিনেমার ঢঙে ছবির সিরিজ করার মতো বড় কাজও পাচ্ছেন আলোকচিত্রীরা।

নিয়মিত আলোকচিত্রের চর্চা হয় এখানে এখনও। বছর বারো আগে ‘দ্বিমাত্রিক’ নামে একটি একটি ফটোগ্রাফি ক্লাব করেছেন কয়েক জন আলোকচিত্রী। নিয়মিত ছবি তোলা, খুব ছোট আকারে হলেও ছবির প্রদর্শনীর আয়োজন করেন তাঁরা। কয়েক জন আবার ছবির নেশায় কখনও দল বেঁধে, কখনও একাই পাড়ি জমান বিভিন্ন এলাকায়। হালিশহরে ‘সীমানা পেরিয়ে’ নামে একটি ভ্রমণ পত্রিকাও চালান এই আলোকচিত্রীরা। ফটোগ্রাফি ক্লাবের সভাপতি এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা পরিতোষ দাস বলেন, ‘‘আমাদের সাধ্য কম কিন্তু সাধ অনেক। ছবি তোলার নেশাটা রক্তের মধ্যে মিশে গিয়েছে।’’

তা না হলে কেনই বা হালিশহরের অন্নপূর্ণা স্কুলের দিদিমনি কাজল বিশ্বাস শুধু ছবির টানে বারবার ঘর ছাড়েন? সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন নিজের ক্যামেরাটা নিয়ে। এই প্রজন্মের সৌগত চট্টোপাধ্যায়, ভাস্কর পালরাও হালিশহরকে ফ্রেমবন্দি করেন ঘুরে ঘুরে। শহরকে পর্যটনকেন্দ্র করতে সরকার উদ্যোগী। উদ্যোগী বাসিন্দারাও। চিত্র সংবাদিক দেবাশিস রায় হালিশহরের যে জায়গাগুলি নিয়ে পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে, সেগুলির ছবি তুলে ‘পর্যটন হালিশহর’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছেন। প্রবীণ আলোকচিত্রীদের মধ্যে মণি ভট্টাচার্য, প্রণব মুখোপাধ্যায়, স্বপন চক্রবর্তীরা আছেন। যাঁদের সংগ্রহে বহু দুষ্প্রাপ্য ছবি আছে। কিন্তু সংরক্ষণ হয়নি ঠিক মতো। ছবি তুলতে ভালবাসেন হালিশহরের পুরপ্রধান অংশুমান রায়ও। তিনি বলেন, ‘‘হালিশহরের যা পুরনো ছবি আছে, এ বার অন্তত তা সংগ্রহ করে মিউজিয়ামে রাখার ব্যবস্থা করব। সব আলোকচিত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করেছি, আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র দিবসে এটাই এখন হালিশহরের আলোকচিত্রপ্রেমীদের সংকল্প হোক।’’

(চলবে)

bitan bhattachary halishahar halishahar photography halishahar heritage halishahar river chandrakanta palit bankubihari basu
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy