হঠাৎ কাচ ভাঙার শব্দ। চুরমার হয়ে গেল মহিলা মেডিসিন বিভাগের সামনের করিডরের টিউব।
কী হল কী হল...। ভাবতে ভাবতেই এ বার ওয়ার্ডের মধ্যে দুম দুম করে ভাঙল আরও দু’টো টিউব। সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়া। স্যুইচ বোর্ড থেকে ঠিকরে বেরোতে লাগল আগুনের ফুলকি।
বৃহস্পতিবার সন্ধে পৌনে ৭টা নাগাদ বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালে এই ঘটনায় আতঙ্ক ছড়ায়। রোগিণীরা ছুটোছুটি শুরু করেন। নীচের তলা থেকে উঠে আসেন আত্মীয়-স্বজন। এলাকার লোকজন খবর পেয়ে ভিড় করেন। তখন অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছে বিশাল হাসপাতাল চত্বর। খবর পেয়ে আসে দমকলের দু’টো ইঞ্জিন। আসে পুলিশ। রোগীকল্যাণ সমিতির সভাপতি তথা বনগাঁ মহকুমাশাসক সুদীপ মুখোপাধ্যায়ও আসেন এলাকায়। তবে ততক্ষণে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ব্যবহার করে আগুন, ধোঁয়া আয়ত্তে এনেছেন হাসপাতালের কর্মীরাই। রাত পৌনে ৮টা নাগাদ আলো আসে হাসপাতালে।
উত্তর ২৪ পরগনার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রলয়কুমার আচার্য জানিয়েছেন, সন্ধে ৬টা ২৫ মিনিট নাগাদ লোডশেডিং হয়েছিল। জেনারেটর জ্বালানোর পরেই বিপত্তি। পূর্ত দফতরের বাস্তুকারেরা হাসপাতালে এসে সব খতিয়ে দেখছেন। পরিস্থিতি আপাতত স্বাভাবিক বলেই দাবি করেছেন তিনি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, যে সব রোগী ভর্তি ছিলেন, তাঁদের ঠিকঠাক দেখভাল করা হচ্ছে।
বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজে ক’দিন আগেই অগ্নিকাণ্ডের জেরে ধুন্ধুমার বাধে। রোগী, তাঁদের আত্মীয় এবং হাসপাতাল কর্মীরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। দমবন্ধ হয়ে মারা যান দু’জন। পরে মৃত্যু হয় আরও একজনের। সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার স্মৃতি এখনও টাটকা। তারই মধ্যে বৃহস্পতিবার বনগাঁ হাসপাতালে এই কাণ্ড।
বনগাঁয় এ দিন ঘটনার পরে রোগিণীদের অনেকে চিৎকার, কান্নাকাটি জুড়ে দেন। নার্সরা দ্রুত খবর দেন ওয়ার্ড মাস্টারের ঘরে। নার্সরাই আলো-পাখার স্যুইচ বন্ধ করে দেন। ওয়ার্ডের জানলায় মশা আটকাতে নেট লাগানো আছে। হাওয়া আসার জন্য ছিঁড়ে ফেলা হয় সেই নেট। ততক্ষণে ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে অনেকের। স্যালাইনের চ্যানেল খুলে অনেকে দৌড় দিয়েছেন সিঁড়ির দিকে। সেখানেও নীচে নামার জন্য তখন চলছে হুড়োহুড়ি।
আতঙ্কে অনেকে ওয়ার্ড ছেড়ে নেমে এসেছেন নীচে। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
মধুমিতা সরকার নামে এক বালিকা জ্বর নিয়ে ভর্তি ছিল ওয়ার্ডে। তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। কান্না শুরু করে। হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল, একজন আয়া তার মাথার কাছে বসে হাওয়া করছেন। একে আলো নেই, তার উপরে চারিদিক ধোঁয়ায় ঢাকা, অন্ধকার— সব মিলিয়ে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি।
এ দিকে, অনেক রোগিণী যেমন নীচে নেমে এসেছিলেন, আত্মীয়েরা যাঁরা নীচে ছিলেন, তাঁরাও তড়িঘড়ি অনেকে উপরে উঠে ঢুকে পড়েন ওয়ার্ডে। সোমা দাস নামে চাঁদপাড়ার এক মহিলা জ্বর নিয়ে ভর্তি ছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘টিউবগুলো শব্দ করে ফাটার পরেই ধোঁয়ার গন্ধ নাকে এল। আর তারপরে দেখলাম, চারদিক থেকে গল গল করে ধোঁয়া এসে ঢেকে দিল গোটা ঘর। আমি চিৎকার করতে করতে নীচে নেমে আসি। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম, চিকিৎসা করাতে এসে বুঝি আগুনে পুড়ে মরতে হবে!’’
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ভারতী দাস নামে শ্বাসকষ্টের এক রোগিণী আতঙ্কে নীচে নেমেছিলেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরে তাঁর খোঁজ মিলছিল না। পরে জানা যায়, তাঁকে বাড়ি নিয়ে চলে গিয়েছেন আত্মীয়েরা।
গোটা হাসপাতাল চত্বর যখন অন্ধকারে ঢেকে আছে, তখন মোমবাতি কিনে আনেন রোগীর আত্মীয়দের কেউ কেউ। মোমের আলোয় রোগীর খোঁজ-খবর করতে দেখা গিয়েছে চিকিৎসকদের।
সব মিলিয়ে আতঙ্ক ছড়ালেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যে দ্রুততার সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন, তাতে স্থানীয় লোকজন, রোগীর আত্মীয়-স্বজন সাধুবাদই জানাচ্ছেন।