মূল অভিযুক্ত শ্যামল ও তাঁর যে সঙ্গীদের বিরুদ্ধে এ দিন এফআইআর হয়েছে, তারা পলাতক। তাদের খোঁজে এর মধ্যে কোনও অভিযান হয়েছে কি? জেলা পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী বলেন, “অভিযুক্তদের খোঁজে তল্লাশি চলছে। এলাকায় টহল দিচ্ছে পুলিশ।” দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় এমন ঘটনা এবং তার প্রতিকারে পুলিশ-প্রশাসনের গয়ংগচ্ছ মনোভাব দেখে স্থানীয় মানুষেরা অবশ্য আশা রাখতে পারছেন না। বরুণের দিদি প্রমীলাও বলেন, “রাজ্যে সমাজবিরোধী কাজকর্ম বাড়ছে। পুলিশ-প্রশাসন নির্বিকার। তাই বারবার বরুণের মতো প্রতিবাদী ছেলেদের চলে যেতে হয়।” উদাহরণ হিসেবে সকলেই বরুণের সঙ্গে রিঙ্কু দাসের ভাই রাজীব দাসের প্রসঙ্গও তুলছেন। দিদিকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিল রাজীব। কিন্তু তিন বছরেও বিচার শেষ করে রায় দান সম্ভব হয়নি।
কী হয়েছিল শুক্রবার রাতে?
বনগাঁ জিআরপি-র কাছে দায়ের করা অভিযোগে সৌরভের দাদা সন্দীপ জানিয়েছেন, রাত সওয়া ১১টা নাগাদ টিভিতে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখার ফাঁকে মোবাইলে কথা বলতে বাড়ির বাইরে বেরিয়েছিলেন সৌরভ। বাড়ির সামনেই রাস্তায় পায়চারি করতে করতে কথা বলছিলেন। রাস্তার উল্টো দিকে একটু দূরেই চৌধুরী পরিবার আরও একটি বাড়ি তৈরি করছে। নির্মীয়মাণ সেই বাড়ির ছাদে ছিলেন সন্দীপ। তিনি দেখতে পান, শ্যামল ও আরও কয়েক জন যুবক সৌরভের সঙ্গে কথা বলছে। গোলমাল আন্দাজ করে ছাদ থেকে নেমে আসেন সন্দীপ। শুনতে পান, ভাইকে শ্যামল বলছে, “সে দিন তো তুইও গণ্ডগোলের সময়ে ছিলি।” সন্দীপ প্রতিবাদের চেষ্টা করলে তাঁর দিকে রিভলভার উঁচিয়ে গুলি চালিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় এক দুষ্কৃতী। এর পরে সৌরভকে টানতে টানতে নিয়ে যায় রাস্তা দিয়ে।
‘সে দিন’ বলতে কোন দিনকে বুঝিয়েছিল শ্যামল? সৌরভের পরিবার ও এলাকার বাসিন্দাদের বক্তব্য অনুযায়ী, শ্যামল ও তার দলবল তোলাবাজি, গুন্ডামি করে বেড়াত। বাইরে থেকে দুষ্কৃতী জড়ো করত। নিজেদের কার্যকলাপ ঢেকে রাখতে বারবার ট্রান্সফর্মারের লাইন কেটে এলাকা অন্ধকার করে দিত। সপ্তাহ দুয়েক আগে এই সব ঘটনার প্রতিবাদ করায় প্রহৃত হন এক ব্যক্তি। এর পরেই রুখে দাঁড়ান স্থানীয় কিছু যুবক। মারধর করেন শ্যামলদের। শুক্রবার সৌরভকে তুলে নিয়ে যাওয়ার আগে এই ঘটনার কথাই বোঝাতে চেয়েছিল শ্যামল, দাবি সন্দীপদের।
সৌরভকে নিয়ে ওরা চলে যেতে চিৎকার শুরু করেন সন্দীপ। আশপাশের লোকজন জড়ো হলে রাতেই খোঁজ শুরু হয়। খবর যায় দত্তপুকুর থানায়। ভোরের দিকে সৌরভের দেহাংশ মেলে রেল লাইনের আশপাশ থেকে। উত্তেজিত জনতা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। দফায় দফায় রেল ও সড়ক অবরোধ হয়। পুলিশ লাঠি চালিয়ে অবরোধ তুলতে গেলে জনা দশেক বাসিন্দা জখম হন বলেও অভিযোগ। এর মধ্যে এলাকায় একটি চোলাইয়ের ঠেকেও এলাকার লোকজন ভাঙচুর চালায়। অভিযোগ, শুক্রবার রাতে শ্যামলকে সেখানে বসে মদ খেতে দেখা গিয়েছিল। শ্যামল-সহ উত্তম শিকারি, অনুপ তালুকদার, লিটন তালুকদার ও কয়েক জনের বিরুদ্ধে বনগাঁ জিআরপি-র কাছে ভাইকে খুনের অভিযোগ করেছেন সৌরভের দাদা সন্দীপ।
পারিবারিক পরিচয়ে সৌরভরা বিজেপি-ঘনিষ্ঠ। বাবা সরোজবাবু জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ায় কর্মরত। তিনি বিজেপির কুলবেড়িয়া অঞ্চল সভাপতিও বটে। মা মিতাদেবী গত পঞ্চায়েত ভোটে বিজেপির টিকিটে ছোট জাগুলিয়া থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। তবে সৌরভ কোনও রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গেই যুক্ত ছিল না বলে দাবি পরিবারের। একই কথা জানিয়েছেন সৌরভের বন্ধু ও প্রতিবেশীরাও।
কিন্তু তাতেও রাজনীতিকে এড়ানো যায়নি। বিজেপি থেকে তৃণমূল, সকলেই সৌরভকে নিজেদের কর্মী বলে দাবি করেছে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, “দত্তপুকুরে আমাদের দলের এক কর্মীকে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা খুন করেছে। তিনি এলাকায় অসামাজিক কাজকর্মের প্রতিবাদ করতেন।” আজ, রবিবার দুপুরে রাহুলবাবু এলাকায় যাবেন বলে জানিয়েছেন। এ দিন ঘটনার খবর শুনে এলাকায় এসেছিলেন বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্য। সৌরভের মৃত্যুর প্রতিবাদে আজ, রবিবার সকাল ৬টা থেকে বামনগাছিতে ১২ ঘণ্টা বন্ধের ডাক দিয়েছে বিজেপি। বন্ধ ডেকেছে এসইউসি-ও।
তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি তথা খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকও দাবি করেন, বিরাটি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সৌরভ আদতে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতা। সৌরভের মৃত্যুর ‘প্রতিবাদে’ এবং ছাত্রছাত্রীদের ‘নিরাপত্তার দাবিতে’ বিরাটি কলেজে টিএমসিপি রাজ্য সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডার নেতৃত্বে অধ্যক্ষকে ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখায়। তবে এ দিন সৌরভের বাড়িতে কোনও তৃণমূল নেতা যাননি।
এলাকার মানুষ শুনিয়েছেন আর এক কাহিনি। তাঁদের দাবি, এই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত শ্যামল কর্মকার ছোট জাগুলিয়া পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য তুষার মজুমদার ওরফে বিশুর ঘনিষ্ঠ। শ্যামলকে বিশুর সঙ্গে প্রায়ই দেখা যেত, জানিয়েছেন তাঁরা। শ্যামল ও তার দলবল এলাকায় গুন্ডামি, তোলাবাজি এবং আরও নানা রকম অসামাজিক কার্যকলাপ চালাত। প্রতিবাদ করতে গেলেই মারধর করত। এই নিয়ে সম্প্রতি তৃণমূল নেতা বিশুবাবুকে সব কিছু জানানো হয়। সৌরভের দাদা সন্দীপের বক্তব্য, বিশুবাবু এলাকার কিছু লোকজনকে ডেকে বৈঠক করে জানান, এর পরে শ্যামল ও তার দলবল যাতে কোনও গোলমাল না পাকায়, তা তিনি দেখবেন। এমনকী, শ্যামল যদি কিছু করে বসে, তবে তার দায়ও তিনি নেবেন বলে জানিয়েছিলেন। যদিও সৌরভকে বাড়ির সামনে থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে ওই রাতে বিশুকে খবর দেওয়া হলেও তিনি কোনও সাড়া দেননি, অভিযোগ সন্দীপের।
শনিবার অবশ্য ওই তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য বলেন, “এলাকায় দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য কমাতে আমি স্থানীয় মানুষকে নিয়ে বৈঠক করেছিলাম ঠিকই, কিন্তু ভবিষ্যতে শ্যামলের দুষ্কর্মের দায় নেব এমন কথা বলিনি।” বিশুবাবুর দাবি, “আমি শ্যামলকে চিনিই না।”
এ দিন সৌরভের দেহাংশ উদ্ধার করে বনগাঁ জিআরপি পাঠায় বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালে। হাসপাতালের সুপার গয়ারাম নস্কর জানিয়ে দেন, টুকরো টুকরো দেহাংশের ময়না-তদন্ত করার মতো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই সেখানে। তাই দেহাংশ রবিবার এনআরএস হাসপাতালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে প্রকৃত সত্য ধামাচাপা দিতে শাসক দল ময়না-তদন্ত কলকাতায় করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কি না, সে প্রশ্ন তুলেছে সৌরভের পরিবার।
এর মধ্যে রেলের একটা দাবি নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়। পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র জানান, ৩৩৬৫১ শিয়ালদহ-হাবরা লোকালে এক জন কাটা পড়েছে বলে তাঁরা সকালে খবর পান। তবে সেই কাটা পড়ার ঘটনা ঠিক কখন, তা রেল স্পষ্ট করেনি। সকাল ৮টা ১০ থেকে বিক্ষোভ শুরু হয়, জানিয়েছে রেল। যদিও স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, ভোরের আলো ফোটার আগেই দেহ খুঁজে পান তাঁরা। বিক্ষোভও চলে তখন থেকেই। শিয়ালদহের রেল পুলিশ সুপার উত্তম নস্কর জানিয়েছেন, রেলে কাটা পড়ে মৃত্যু হয়েছে, না খুন করা হয়েছে ওই যুবককে, তা ময়না-তদন্তের রিপোর্ট এলেই জানা যাবে।
মৃত্যু যে ভাবেই হোক, এর পিছনে যে দুষ্কৃতীদের হাত রয়েছে, সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ এলাকার সকলে। তাঁরা বলছেন, সুটিয়া গণধর্ষণ কাণ্ডের অন্যতম সাক্ষী, মিত্র ইনস্টিটিউশনের শিক্ষক বরুণকে গোবরডাঙা স্টেশনের সামনে গুলি করে খুন করা হয় বলে এর মধ্যেই জানিয়েছে সিআইডি। তার দু’বছরের মাথায় প্রাণ গেল সৌরভের। মৃত্যু হল আর এক প্রতিবাদীর। কিন্তু পরিবর্তন হল না কোনও কিছুরই।