Advertisement
E-Paper

স্মৃতি বইছে আধপোড়া বাড়িটুকুই

লোকজন পড়িমড়ি করে ছোটেন দেবুর বাড়ির দিকে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।

শুভাশিস ঘটক

শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৯ ০০:১৪
n রয়ে গিয়েছে শুধু বাড়ি। ছবি: দিলীপ নস্কর

n রয়ে গিয়েছে শুধু বাড়ি। ছবি: দিলীপ নস্কর

ঘরের এক কোণে তক্তপোশ পাতা। তিন দিকে মশারির খুঁট আটকানো। বিছানার চাদরে ধুলো জমেছে। কিন্তু মোটের উপর টান টান করেই পাতা। একটা পিতলের খালি কলসি। টালির চালের উপরে একা দাঁড়িয়ে অ্যান্টেনা। আটপৌরে সংসারের ছবি। শুধু বিপর্যয়ের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে মেঝের এক কোণে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা ছোট্ট টিভিটা। ঘরে ঢুকতে গিয়ে চোখে পড়ে কালো পোড়া দাগ ধরা দরজার পাল্লা। ঘর-লাগোয়া দরমার বেড়ায় পোড়া কালো ছোপের দাগ।

গত পঞ্চায়েত ভোটের আগের দিন কাকদ্বীপের বুধাখালি পঞ্চায়েতের সিপিএম নেতা দেবু দাস (৪৮) ও তাঁর স্ত্রীর উষারানির (৪২) আধপোড়া দেহ উদ্ধার করা হয়েছিল ওই বাড়ি থেকে। তাঁদের মুখ-হাত কাপড় বাঁধা অবস্থায় ছিল।

জোড়া খুনের ঘটনায় রাজ্য জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। তৃণমূলকে দায়ী করে আন্দোলন শুরু করে সিপিএম। শেষমেশ গ্রেফতার হয় স্থানীয় ১১ জন সিপিএম ও দুই তৃণমূল কর্মী। সকলেই জামিনে মুক্ত। এই আবহেই ফের ভোট বুধাখালিতে। স্বাধীনতার পর থেকে সিপিএমের দখলেই ছিল পঞ্চায়েতটি। গতবার অবশ্য পালাবদল হয়েছে। বুধাখালি এখন তৃণমূলের দখলে।

১১৭ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে নেমে গ্রামের ইটপাতা রাস্তা ধরে মাইলখানেক এগোলে নদীর কাছে দেবু দাসের বাড়ি। খোঁজখবর করার সময়ে এগিয়ে এলেন বছর ষাটেকের জয়দেব সামন্ত। বললেন, ‘‘বাড়িটাকে আমরা ওরকমই রেখে দিয়েছি দেবুর স্মৃতি হিসাবে।’’

জয়দেব জানালেন, যে রাতে খুন হলেন দেবুরা, সে দিন দু’জনে এক সঙ্গে বাজার করে ফিরেছিলেন। পাড়ার মোড়ের দোকানে তাস খেলতে বসে যান জয়দেব। দেবু বাড়ির পথ ধরেন। রাত প্রায় সাড়ে ১০টা দেবুর ছেলে দীপঙ্করের সঙ্গে দেখা হয়েছিল জয়দেবের। ক্যাটারিংয়ের কাজ করতেন দীপঙ্কর। কাকদ্বীপ থেকে থলিতে করে মায়ের জন্য দই-মিষ্টি নিয়ে যাচ্ছিলেন বাড়ির দিকে। জয়দেবের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে তাঁকেও খানিকটা দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। জয়দেব বলেছিলেন, বাড়ির জন্য নিয়ে যাচ্ছ যখন, বাড়িতেই যাও। এত রাতে আর দাঁড়িয়ে কাজ নেই।

বাড়ির দিকে চলে যান দীপঙ্কর। একটু পরেই ছুটতে ছুটতে এসে খবর দেন, ‘‘তোমরা এখানে, আর এ দিকে আমার বাবা-মা পুড়ছে।’’

লোকজন পড়িমড়ি করে ছোটেন দেবুর বাড়ির দিকে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। জয়দেব বলেন, ‘‘এ গ্রামে আমরা সকলেই সিপিএম সমর্থক। ভোট দিয়েছিলাম সকলেই। ভোটের দিন বিকেলে শাসক দলের কর্মীরা মিছিল করে বলে দিয়েছিল, ওরাই জিতছে। হলই তা-ই।’’

ভোট মিটে যাওয়ার কয়েক দিন পরে পুলিশ গ্রেফতার করে জয়দেবকে। সিপিএম কর্মী সুকুমার হালদারও ধরা পড়েছিলেন। তিনি বললেন, ‘‘ঘটনার রাতে আমাদের পাড়ার এক বাড়িতে বাইরে থেকে অনেক লোক এসেছিল। মাংস-ভাত রান্না হচ্ছিল। আর কিছু বলতে পারব না।’’

বাইরে থেকে আসা ওই লোকেরাই কী তবে...? প্রশ্নটা পুরোটা শুনতেই চাইলেন না সুকুমার। মাঝপথে থামিয়ে বললেন, ‘‘আমি সামান্য মানুষ। ভেড়িতে কাজ করে খাই। বেশি কথা বললে ওই কাজটাও বন্ধ হয়ে যাবে।’’

জোড়া খুনের ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিতেই দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের সহ সভাপতি শক্তি মণ্ডল বলেন, ‘‘ওই ঘটনায় শুধু সিপিএম নয়, আমাদেরও দুই সমর্থককে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তদন্ত এখনও চলছে। এর বেশি কিছু বলব না।’’

বিশেষ কিছু বলতে চান না দীপঙ্করও। গ্রামে বাড়িতে যানও না। থাকেন সন্তোষপুরে, এক আত্মীয়ের বাড়িতে। কলেজে পড়েন। বললেন, ‘‘পুরনো কথা আর মনে করতে চাই না। জীবন নতুন করে শুরু করতে চাই।’’ পুরনো স্মৃতি শুধু জেগে থাকে আধপোড়া বাড়িটার পরতে পরতে।

Panchayat Election TMC CPM Kakdwip
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy