Advertisement
E-Paper

তেষ্টা মিটিয়ে পথিককে তোফা রাখেন জলবাবু

ঘামে ভেজা কোনও পথিককে তিনি ফেরান না। দেখলেই এক কথা— ‘একটু জল খেয়ে নিন, শরীরটা ভাল লাগবে’। সঙ্গে থাকা ব্যাগের বোতল থেকে জল দেন পথিককে। পথিক জিরিয়ে নেন।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:৪৪
স্কুলে গিয়ে ছাত্রদের জল খাওয়াচ্ছেন জলবাবু। —নিজস্ব চিত্র।

স্কুলে গিয়ে ছাত্রদের জল খাওয়াচ্ছেন জলবাবু। —নিজস্ব চিত্র।

ঘামে ভেজা কোনও পথিককে তিনি ফেরান না।

দেখলেই এক কথা— ‘একটু জল খেয়ে নিন, শরীরটা ভাল লাগবে’। সঙ্গে থাকা ব্যাগের বোতল থেকে জল দেন পথিককে। পথিক জিরিয়ে নেন।

গোপালনগরের ‘জলবাবু’র জন্যই রাস্তাঘাটের কোনও তৃষ্ণার্তকে সুকুমার সাহিত্যের ‘পুবগাঁয়ের পথিক’-এর মতো নাস্তানাবুদ হতে হয় না। জল চাইলে ‘জলবাবু’ জলই দেন। পথিককে জলপাইয়ের কথা শুনতে হয় না! ‘খাসা জল’, ‘তোফা জল’ বা ‘চমৎ‌কার জল’-এর গোলোকধাঁধায় ঘুরতে হয় না! পিপাসার মুখে ‘বিষ্টির জল, ডাবের জল, নাকের জল, চোখের জল’-এর ফর্দ শোনাও দূরঅস্ত্!

তৃষ্ণার্তকে জল খাওয়াতে খাওয়াতে এ ভাবেই উত্তর ২৪ পরগনার গোপালনগরের বলরাম চক্রবর্তীর নাম হয়ে গিয়েছে ‘জলবাবু’। ব্যাগ ভর্তি জলের বোতল নিয়ে তিনি টানা ২০ বছর ধরে পৌঁছে যাচ্ছেন হাটে-বাজারে, গ্রামে-শহরে, রাজ্যের নানা প্রান্তে, ভিন্ রাজ্যেও! এলাকার অফিস ফেরত যাত্রী, মাঠের চাষি, সমাবেশের জনগণ কিংবা পথচলতি মানুষ, যাঁরাই তাঁকে চেনেন, হাঁক দেন— ‘একটু জল খাইয়ে যাবেন জলবাবু’।

পুণ্য সঞ্চয়ের জন্য নয়, শুধুমাত্র সমাজে কিছু একটা করার তাগিদেই এমন কাজ বেছে নিয়েছেন বলরামবাবু। গোপালনগর স্টেশনের পাশে একটি টিনের ঘরে তাঁর সংসার। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। পেশা বলতে খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন জোগাড় করা আর লটারির টিকিট বিক্রি। কিন্তু মন পড়ে থাকে নেশায়। তৃষ্ণার্তকে জল খাওয়ানোয়। এলাকায় থাকলে সব সময়ের সঙ্গী রং চটা সাইকেল। তাতে কাপড়ের উপরে লেখা— ‘জলদান কেন্দ্র, বলরাম (ময়লা) চক্রবর্তী, গোপালনগর, উত্তর চব্বিশ পরগনা’। সাইকেলের হ্যান্ডেল, ক্যারিয়ারে ঝোলানো ব্যাগে থাকে জলের বোতল।

কিন্তু এমন বিচিত্র নেশার কবলে পড়লেন কী করে ‘জলবাবু’?

স্মৃতিতে ডুব দেন মানুষটি। অনেকদিন আগের কথা। গোপালনগরে অষ্টপ্রহর কীর্তন শুনতে গিয়েছিলেন। কেউ কেউ জল খেতে চাওয়ায় এনে দেন বলরামবাবু। সেই শুরু। প্রথম প্রথম যেচে জল দেওয়ার পিছনে নির্ঘাৎ তাঁর কুমতলব আছে ভেবে কেউ গালিগালাজ করেছে, মারধর করেছে। তবু থেমে যাননি মানুষটি। কবি সম্মেলন থেকে সাহিত্য বাসর, মেলা থেকে কীর্তনের আসর— জল নিয়ে পথে-পথে ঘুরছেন। এলাকায় কিছু ভ্রমণ সংস্থা সাহায্যকারী হিসেবে এবং জল খাওয়ানোর জন্য মানুষটিকে সঙ্গে নেয়। সেই সুযোগে ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, পুদুচেরি, কর্নাটক, গোয়া, মহারাষ্ট্র-সহ নানা জায়গা ঘোরা হয়ে গিয়েছে মধ্য পঞ্চাশের বলরামবাবুর। দেখেছেন নাসিক বা উটির গ্রামে তীব্র জলসঙ্কট। বেড়াতে বেরিয়েও কয়েক ক্রোশ দূর থেকে জল বয়ে এনে সেই সব সুখা জায়গার মানুষকে খাইয়েছেন। কেউ তাঁকে আশীর্বাদ করেছেন। কেউ প্রণাম। বলরামবাবুর কথায়, ‘‘বাংলায় যে জিনিস মানুষ সবচেয়ে বেশি অপচয় করে, অন্য জায়গায় সেই এক ফোঁটা জলের জন্য যে কী কষ্ট, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না!’’

গোপালনগর এলাকাটি আর্সেনিকপ্রবণ। তাই এখানে বিশুদ্ধ পানীয় জলের চাহিদা বরাবর। গভীর নলকূপ থেকে সেই জল জোগাড় করেন তিনি। এলাকায় এতটাই জনপ্রিয় যে কেউ তাঁর সম্পর্কে তির্যক মন্তব্য করলেই খেপে ওঠেন স্থানীয়েরা। তাঁদেরই একজন গোপাল মিস্ত্রি। তিনি বলেন, ‘‘এখানে জল মানে তো বিষ-জল। বলরামবাবু আছে বলেই বিশুদ্ধ পানীয় জল পাই। এমন করে আর কে ভাবে?’’ বনগাঁ হাইস্কুলের ছাত্রেরাও এক ডাকে চেনেন ‘জলবাবু’কে। তারা বলে, ‘‘উনি ভালবেসেই কাজটা করেন। এমন মানুষ দেখা যায় না।’’

স্ত্রী অনিতাদেবী স্বামীর এই কাজে গর্বিত। তিনি বলেন, ‘‘সামর্থ্য থাকলে উনি সমাজের জন্য অনেক কিছু করতে পারতেন। নেই বলেই জলদানকে বেছে নিয়েছেন।’’

জল দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে লোকগীতি-পল্লিগীতি লেখেন। সুর দেন। আর তাঁর স্বপ্নের কথা কেউ জানতে চাইলে জলবাবু বলেন, ‘‘যত দিন বাঁচব, সাধ্যমতো মানুষকে জল খাইয়ে যাব।’’

বিনিময়ে শুনতে চান— ‘আহ্, বাঁচা গেল!’’

wayfarers water Distribution Free
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy