সাহসী যুবক প্রণয়।
বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, সোঁদরবনের মানুষ সে কথা ঠারেঠোরে বিশ্বাস করেন।
আর ওঝায় ছুঁলে?
নামখানার প্রান্তিক গ্রাম পাদতিবুনিয়া বলছে— ‘তা তুমি বাপু সেরেও উঠতে পার, আবার ভবলীলা সাঙ্গও হয়ে যেতে পারে!’
অনর্গল প্রচার, স্থানীয় যুক্তিবাদী সংগঠনের লাগাতার প্রয়াস, হেল্পলাইন— ঘুম হয়তো ভেঙেছে তবে, তা যে এখনও নিতান্ত আড়মোড়া ভাঙার স্তরে, শুক্রবার, পাতিবুনিয়ার ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে ফের তা দেখিয়ে দিচ্ছে।
দিন তিনেক আগে, সাপে কাটা দেহ ময়না-তদন্ত না করে মুড়িগঙ্গায় ভেসে যেতে দেখেছিল সাগর। আর রোগীকে বাড়িতেই রেখে ওঝা-গুনিনের মন্ত্রোচারণের সঙ্গেও যথেচ্ছ আলাপ এখনও রয়েছে গ্রাম বাংলায়।
শুক্রবার তেমনই একটা ঘটনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিল পাতিবুনিয়ার যুবক প্রণয় দলুই।
শিবরামপুর পঞ্চায়েতের পাতিবুনিয়ায় প্রণয়ের পড়শি নিত্য মণ্ডলের স্ত্রী সুলেখাকে পুকুর পাড়ে সাপে কেটেছিল। দ্বারিকপুর স্বাস্থ্যকেন্দ্র তেমন অগম্য নয়। দূরে তো নয়-ই। তবু তলব হয়েছিল ওঝা শেখ মহম্মদের।
ওঝার কেরামতি দেখতে ভিড়ও জমেছিল বেশ। প্রণয় তা দেখেই এগিয়ে এসেছিল। প্রণয়ের কথায়, ‘‘সুলেখা কাকিমা আমাদের খুবই কাছের। গিয়ে দেখি, ওঁর ক্ষতস্থানে ছুরি দিয়ে কী সব করছিল ওঝা। আমি বলি, এ সব কেন করছেন? রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে দিন।’’ তার পর নিজেই ওঝাকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে সুলেখাকে নিযে গিয়েছিলেন হাসপাতালে।
দ্বারিকনগর হাসপাতালে চিকিৎসার পরে সুস্থ সুলেখাকে বিকেলেই ছেড়ে দেওয়া হয়।
তবে, ঘটনা এর পরেই তেতে উঠেছিল। শনিবার ওই গ্রামে এক দল ওঝা-গুনিন এসে দাবি করেন— বাড়ি ডেকে এমন অপমান তাঁরা সহ্য করবেন না। এর পরে আর ও গাঁয়ে কোনও ওঝা পা দেবেন না বলেও শাসিয়ে যান তাঁরা। গাঁয়ের অনেকেই দাঁড়িয়ে পড়েন ওঝার পাশে। শনিবার গ্রামে সালিশিরও ডাক দেয় মাতব্বরেরা।
বিপদ আঁচ করে পুলিশে খবর দেন প্রণয়। এলাকায় পুলিশ আসতেই ওঝা এবং তাদের সমর্থকেরা গা ঢাকা দিলেও চাপা শাসানি চলতে থাকে বলে ওই যুবকের দাবি। নিত্যর কথাতেই তা স্পষ্ট, ‘‘আমাদের এখানে ওঝাই ভরসা। ওরা গ্রামে না এলে তখন কে রক্ষা করবে, প্রণয়!’’
কিন্তু প্রণয়ের তৎপরতাতেই তো প্রাণে বাঁচলেন স্ত্রী। কাজটা তো কিছু খারাপ করেননি ওই যুবক। এ কথা অবশ্য মানতে চাননি নিত্য ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা। উল্টে ওই ওঝাকে মারধর করা হয়েছে বলে দাবি করেন।
তবে গ্রামের ভগবতী দলুই, তাপসী দলুইরা বলছেন, ‘‘ওরা আসলে প্রণয়কে ফাঁসাতে চাইছে। মারধর তো দূরের কথা, প্রণয় না থাকলে সে দিন সুলেখা বাঁচত?’’
প্রণয়রে দাবি, স্থানীয় পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান নিখিল মাইতিও তাঁকে ফোনে জানিয়েছেন, ‘আমরা তোমার পাশে নেই’।
নিখিল অবশ্য সে কথা মানছেন না। তাঁর অস্পষ্ট জবাব— ‘‘সাপে কাটলে ওঝা ডেকে গাছগাছড়া দিয়ে ভাল করে তোলার রীতি পুরনো। সরকারের তরফে হাসপাতালে চিকিৎসার উপরে যেমন জোর দেওয়া হচ্ছে, তেমনই এ সবের উপরে মানুষের বিশ্বাসের কথাটাও আমাদের মাথায় রেখে চলতে হবে।’’
ক্যানিংয়ের যুক্তিবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থার সম্পাদক বিজন ভট্টাচার্য অবশ্য প্রণয়ের কাজের তারিফ করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘সাপে কাটলে ওঝা-গুনিনের মন্ত্র যে নিছক বুজরুকি, সে কথা যাঁদের সুমতি হয়েছে, তাঁরা মানছেন। ওঝাদের অনেকেই তো এখন সে পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। তবে, মানুষের সংস্কার এখনও মোছেনি।’’
তা হলে উপায়?
সে প্রশ্নই হাতড়াচ্ছে পাতিবুনিয়া।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy