Advertisement
E-Paper

অবহেলায় রাজ্যের একমাত্র স্পোর্টস স্কুল

ছাত্র-ছাত্রীদের থাকার আবাসনগুলি দীর্ঘদিন ধরেই তালা-বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। দেওয়াল জুড়ে শ্যাওলার কারুকুরি। ঘরের ভিতরে মাকড়সার জাল। শৌচাগারের অবস্থা ভয়াবহ। সুযোগ বুঝে জাঁকিয়ে বসেছে আগাছা। সাপখোপের নিরাপদ আস্তানা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যান্টিনের অবস্থাও তথৈবচ। উপরে টিনের ছাউনি ভেঙে নীচে পড়ে আছে। গাছের কুল পেকে লাল হয়ে আছে। খাওয়ার লোক নেই। আমগাছগুলি মুকুলে ভরে উঠেছে। কেউ ফিরেও তাকায় না।

সীমান্ত মৈত্র

শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৫ ০১:১৩
এই হাল হয়েছে মাঠের। ছবি: শান্তনু হালদার।

এই হাল হয়েছে মাঠের। ছবি: শান্তনু হালদার।

ছাত্র-ছাত্রীদের থাকার আবাসনগুলি দীর্ঘদিন ধরেই তালা-বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। দেওয়াল জুড়ে শ্যাওলার কারুকুরি। ঘরের ভিতরে মাকড়সার জাল। শৌচাগারের অবস্থা ভয়াবহ। সুযোগ বুঝে জাঁকিয়ে বসেছে আগাছা। সাপখোপের নিরাপদ আস্তানা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যান্টিনের অবস্থাও তথৈবচ। উপরে টিনের ছাউনি ভেঙে নীচে পড়ে আছে। গাছের কুল পেকে লাল হয়ে আছে। খাওয়ার লোক নেই। আমগাছগুলি মুকুলে ভরে উঠেছে। কেউ ফিরেও তাকায় না। খেলার মাঠটি পরিচর্যাহীন। দু’টি গোল পোস্ট এখনও মাথা উঁচু করে উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। যে দিকে চোখ যাবে শুধুই অবহেলা ও অনাদরের ছবি। প্রায় ২৫ একর জমির উপরে তৈরি রাজ্যের একমাত্র স্পোর্টস স্কুলের বর্তমান চেহারাটা এমনই দাঁড়িয়েছে।

২০০১ সালে হাবরার বাণীপুরে তৈরি হয় ডক্টর বিআর অম্বেডকর স্পোর্টস স্কুল। রাজ্যের সবেধন নীলমনি, একট মাত্র স্পোর্টস স্কুল। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বাণীপুর পিটিটিআই (প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইন্সিটিটিউট) ইউনিট-১ বন্ধ হয়ে তৎকালীন ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ অতীন্দ্রনাথ দে’র তত্ত্বাবধানে স্পোর্টস স্কুলটি তৈরি হয়েছিল। তাঁকে সহযোগিতা করেছিলেন অভিজিৎ রুদ্র, বিকাশ মণ্ডল, সোমনাথ দত্তর মতো কিছু মানুষ। তখন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন কান্তি বিশ্বাস।

স্কুলটি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অনুমোদন পায়। প্রতি বছর পঞ্চম শ্রেণিতে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি নেওয়া শুরু হয়। পঞ্চম শ্রেণিতে ১৫ জন ছাত্রী ও ১৫ জন ছাত্র ভর্তির সুযোগ পেত। রাজ্যের প্রতি জেলার প্রাথমিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার বিভিন্ন ইভেন্টে যারা প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান লাভ করত, সেই সব ছেলে-মেয়েদের ইন্টারভিউতে ডাকা হত। তাদের স্কুলের মাঠে সরেজমিন ক্রীড়া দক্ষতা ও শারীরিক পরীক্ষা নেওয়ার পরে যারা উপযুক্ত হত, তাদেরই ভর্তি নেওয়া হত এই স্কুলে। পড়ুয়ারা ছিল মূলত গ্রামীণ এলাকার তপসিলি জাতি উপজাতি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত। তাদের খাওয়া-দাওয়া, থাকা, লেখাপড়া ও খেলাধূলার সরঞ্জাম সব কিছুই সরকারি ভাবে বহন করা হত।

এখান থেকে ভবিষ্যতে বহু ভাল খেলোয়াড় জন্ম নেবে, এই ছিল উদ্যোক্তাদের বিশ্বাস। কার্যত কোনও সরকারি কর্মী ছাড়াই স্থানীয় কিছু দক্ষ মানুষকে নিয়ে স্কুলের কাজ শুরু হয়। তাঁদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, সরকারি পদ অনুমোদন হলে তাঁদের সরকারি কর্মী হিসাবে গণ্য করা হবে। অনেকেই অন্য পেশা ছেড়ে এখানে প্রশিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের আর্থিক অবস্থাও এখন শোচনীয়।

২০০৫ সালে স্কুলটি মাধ্যমিকে উন্নীত হয়েছিল। কয়েক জনকে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করা হয়। একজন ইংরাজির ও একজন বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসাবে কাজে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে স্কুলটির দায়িত্ব রাজ্যের সহ শিক্ষা অধিকর্তা (শারীরশিক্ষা) কাছে হস্তান্তরিত হয়। বিভিন্ন সময়ে প্রধান শিক্ষক-সহ কিছু শিক্ষক এখানে যোগ দিয়েছিলেন। আবার তাঁরা চলেও যান। বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ২০০৮ সাল পর্যন্ত এখানকার খেলার মান খুবই উন্নত ছিল। জাতীয় স্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় এখানকার পড়ুয়ারা সাফল্য দেখিয়েছে। মূলত অ্যাথলেটিক্স, জিমন্যাস্টিক, তিরন্দাজি, ফুটবল ও কাবাডি শেখানো হত।

স্কুল শিক্ষা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এখানকার পড়ুয়াদের মধ্যে আন্তনা খাতুন ন্যাশনাল স্কুল গেমসে হাইজাম্পে প্রথম ও ১০০ মিটার দৌড়ে তৃতীয় স্থান পেয়েছিল। তাঞ্জিলা খাতুন হাইজাম্প ও লং জাম্পে প্রথম স্থান পেয়েছিল। পিঙ্কি দে শর্টপাটে প্রথম হয়েছিল।

২০০৮ সাল থেকে পড়ুয়া ভর্তি বন্ধ এখানে। ২০১৩ সাল থেকে স্কুলটি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। তার আগেও অবশ্য ২০০৯ সালে কিছু দিনের জন্য স্কুলটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরে অবশ্য পঠন পাঠন শুরু হয়েছিল। ২০০২-২০১০ পর্যন্ত এখানকার প্রায় ২৫০ জন পড়ুয়া জাতীয় প্রতিযোগিতায় যোগদান করেছে।

স্কুলটির চারিদিকে পাঁচিল দেওয়া। এখন দু’জন শিক্ষক আছেন। তাঁরা হলেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হাসিবুল মল্লিক ও সহ শিক্ষক কাজল দত্ত। তাঁদের থাকার জন্য নির্দিষ্ট আবাসন আছে। স্কুল বন্ধ। ফলে তাঁরা এখন সব সময় থাকেন না। তবে মাস গেলে বেতন পাচ্ছেন। রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী একবার স্কুলটি বাঁকুড়াতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হয়নি।

২০১১ সালে তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে অনেকেই আশার আলো দেখেছিলেন, এ বার হয় তো স্কুলটি ফের স্বমহিমায় ফিরবে। কিন্তু কোথায় কী! শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন ব্রাত্য বসু উদ্যোগ করেছিলেন স্কুল চালু করার। কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি।

বাসুদেব ঘোষ, দিব্যেন্দু চক্রবর্তী, বীরেন্দ্রনাথ ভৌমিকের মতো প্রশিক্ষক দীর্ঘদিন ধরে এখানে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এ ছাড়া আরও ন’জন কর্মী কাজ করেছেন। তাঁরা প্রশাসনের বিভিন্ন মহলে বিভিন্ন সময়ে আবেদন করেছেন স্কুলটি পুনরায় চালু করতে। সকলে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে।

নামকরা সংস্থার চাকরি ছেড়ে এখানে প্রশিক্ষক হিসাবে অস্থায়ী ভাবে যোগ দেন বাসুদেব ঘোষ। স্কুলটির বর্তমান হাল দেখে তিনি হতাশ। বললেন, “আমরা যাঁরা অস্থায়ী কর্মী-প্রশিক্ষক ছিলাম, তাঁদের স্থায়ী করার থেকেও অবিলম্বে স্কুলটি চালু হোক সেটাই আমরা চাই। কারণ খেলোয়াড় তৈরির স্বপ্ন নিয়েই আমরা এখানে প্রশিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়েছিলাম।”

স্কুলটি তৈরির উদ্দেশ্য ছিল, লেখাপড়ার পাশাপাশি ভাল খেলোয়াড় তৈরি করা। জাতীয় গেমসে এ বার বাংলা আশানুরূপ ফল করেনি। তার কারণ জানতে তৎপর হয়েছে রাজ্য সরকার। বিভিন্ন খেলার কর্তাদের কাছ থেকে তার কারণ জানতে চাইছে সরকার। এক প্রাক্তন অ্যাথলেটিকের কথায়, “ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, জাতীয় গেমসে ত্রিপুরার মতো ছোট রাজ্যের থেকেও বাংলার ফল খারাপ হয়েছে। রাজ্যের ক্রীড়া পরিকাঠামো বলে কিছুই নেই। অথচ রাজ্যের একমাত্র স্পোর্টস স্কুলটির দিকে সরকারের কোনও নজর নেই। যে সব ক্লাব খেলে না, তাদের লক্ষ লক্ষ টাকা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এই স্কুলটি খুলতে সরকারের নাকি টাকা নেই!” এক অস্থায়ী কর্মীর কথায়, “রাজ্যের একমাত্র স্পোর্টস স্কুলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুঃস্থ ঘরের বহু প্রতিভা হারিয়ে গিয়েছে। দ্রুত চালু না হলে প্রতিভারা আরও ঝরে যাবে।”

ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হাসিবুল বললেন, “স্কুলটি চালু করতে রাজ্য সরকার ভাবনা-চিন্তা করছেন বলে শুনেছি। এখনও কোনও সরকারি অর্ডার হয়নি। তবে বেতন পাচ্ছি।”

রাজ্যের শিক্ষা দফতরের সহকারী অধিকর্তা (শারীরশিক্ষা) প্রবীর সাহা জানালেন, তাঁদের তরফ থেকে ইতিমধ্যেই শিক্ষা দফতরে ফাইলপত্র পাঠানো হয়েছে। স্কুল খোলার বিষয়টি প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। জেলা পরিষদের পক্ষ থেকেও স্কুলটি খোলার আবেদন জানিয়ে শিক্ষা দফতরে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা পরিষদের সভাধিপতি রহিমা মণ্ডল।

ব্রাত্য বসু শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন স্কুটি পিপিপি মডেলে চালু করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। কমিশনার অব স্কুল এবং স্কুল শিক্ষা দফতরের আধিকারিকেরা স্কুলটি ঘুরে গিয়েছেন। সমীক্ষার কাজও শুরু হয়েছে। শিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, স্কুলটি বন্ধ হওয়ার পিছনে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী না পাওয়াটাও একটা কারণ ছিল। যেখানে ১২ জন শিক্ষক থাকার কথা, সেখানে রয়েছেন মাত্র দু’জন। দীর্ঘদিন ধরে অস্থায়ী কর্মী ও শিক্ষক দিয়ে স্কুলটি চালানো হয়েছিল। তা ছাড়া, স্থায়ী প্রশিক্ষকের ব্যবস্থা না স্কুলটি চালু করাটাও ছিল সরকারি ব্যর্থতা।

আশার কথা শুনিয়েছেন হাবরার বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তিনি জানিয়েছেন, স্কুলটি ফের চালু করতে ৭৭ কোটি টাকা লাগবে। পিপিপি মডেলে চালু করা হবে। প্রাথমিক সমীক্ষার কাজও শেষ হয়ে গিয়েছে। জেলাশাসক স্তরে ফের সমীক্ষা হচ্ছে। রাজ্যর একমাত্র স্পোর্টস স্কুলটি চালু করা হবেই। আপাতত সে দিকেই তাকিয়ে হাবরাবাসী।

(চলবে)

southbengal amar sohor sports school dr br ambedkar sports school habra amar shohor simanto moitra
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy