খোঁজ চলছে দেহের। ইনসেটে, সেই ঘড়ি। —নিজস্ব চিত্র।
জল-কাদার মধ্যে থেকে উঁকি মারছিল মাথার একটা অংশ। আঙুল দিয়ে সে দিকে দেখিয়ে দিল খুনের ঘটনায় ধৃতদের এক জন। মৃত্যুর ৫৪ দিন পরে পুলিশ যখন দেহ বের করল কাদার তলা থেকে, হাতের সোনালি ঘড়িটা তখনও টিকটিক করে চলছে। ওই ঘড়ি দেখেই শিবপুরের ইঞ্জিনিয়ার রজতশুভ্র মুখোপাধ্যায়ের দেহ শনাক্ত করলেন তাঁর মেয়ে রণিতা। বুধবার দুপুরে সন্দেশখালির কানমারি গ্রামের মেছোভেড়ি এলাকায় তখন লোক উপচে পড়েছে। গ্রামের ছা-পোষা দুই ব্যক্তিই যে লাশ পুঁতে রাখার ঘটনায় জড়িত, তখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না কেউ। কী ভাবে দেহ এখানে আনা হল, তা নিয়ে অবশ্য মুখ খোলেননি পুলিশ কর্তারা।
গত ২৩ মে অফিসে যাওয়ার পথে অপহৃত হন শিবপুরের বাসিন্দা রজতবাবু। তাঁর বড় মেয়ে রণিতাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল রজতবাবুর দূরসম্পর্কের শ্যালক শুভেন্দু দে ওরফে পার্থ। রাজি ছিল না মুখোপাধ্যায় পরিবার। এই নিয়ে পার্থর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি। রজতবাবুর সঙ্গে কথা কাটাকাটিও হয় পার্থর। হাওড়া সিটি পুলিশের কর্তারা জানিয়েছেন, রজতবাবু নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পরে মুখোপাধ্যায় পরিবারের কাছে দু’বার লক্ষাধিক টাকা মুক্তিপণ চেয়ে ফোন এসেছিল। ওই সূত্রেই ধরা পড়ে যায় পার্থ। পুলিশের দাবি, জেরায় খুনের কথা স্বীকার করেছে হাওড়ার একটি কারখানার মালিক ওই যুবক। পুলিশ জানায়, ঘটনার দিন অফিস যাওয়ার পথে রজতবাবুকে জিটি রোড থেকে নিজের গাড়িতে তুলে নিয়েছিল পার্থ। সঙ্গে ছিল গাড়ির চালক সন্তু সর্দার, পার্থর কারখানার ম্যানেজার গৌতম সাহু। রাস্তায় কোনও এক জায়গায় রজতকে খুন করা হয়। দেহ লোপাটের দায়িত্ব দেওয়া হয় গৌতমকে। তার মামা রণজিৎ মাইতি সন্দেশখালির বাসিন্দা। রণজিৎ এবং বাবলু জানা নামে আরও এক স্থানীয় বাসিন্দাকে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে দেহ পুঁতে ফেলতে বলা হয়েছিল। পার্থকে জেরা করে গ্রেফতার গৌতম, সন্তু, রণজিৎ ও বাবলুকে। পরবর্তী কাজ ছিল দেহ উদ্ধারের।
সেই মতো, এ দিন বেলা ১২টা নাগাদ সন্দেশখালিতে আসে হাওড়া সিটি পুলিশের একটি দল। সঙ্গে ছিল সন্দেশখালি থানার পুলিশ। ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট কাওসার আলম। রনিতা এসেছিল এক বন্ধুর সঙ্গে। রণজিৎ ও বাবলুকে আনা হয়েছিল পুলিশের গাড়িতেই। নিরাপত্তার কথা ভেবে ঘটনাস্থলের কাছেই একটি গোপন জায়গায় পার্থ, গৌতম ও সন্তুকে রেখেছিল পুলিশ।
কানমারি বাজার পেরিয়ে হাটগাছি পঞ্চায়েত থেকে খানিকটা এগোতেই থেমে যায় পুলিশের গাড়ি। তখন সেখানে তিল ধারণের জায়গা নেই। গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার পাশে লকাই পরামাণিকের বাড়ির ভিতর দিয়ে পুকুরের পাশ হয়ে দলটি এগিয়ে যায় অমূল্য মাইতির মেছোভেড়ির দিকে। রণিতা নিজের মনেই বলে ওঠেন, ‘‘ওরা মনে হয় ভুল করছে। ওখানে কি শুয়ে থাকতে পারে বাবা?” মেছোভেড়ির বাঁধের উপর দিয়ে একটু এগোতেই খানিকটা ঘাস জমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাবলা গাছের ঝোপ। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, জায়গাটি সর্দারপাড়া শ্মশানঘাট। সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে রণজিৎ ও বাবলু। মেছোভেড়ির এক ধারে আঙুল দেখিয়ে রণজিৎ বলে, ‘‘ওই তো মাথা দেখা যাচ্ছে।’’
ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে শুরু হয় ভেড়ির ধারের মাটি কাটা। নরম কাদামাটি একটু সরাতেই বেরিয়ে পড়ে রজতশুভ্রবাবুর পচাগলা দেহ। বুকের উপরে রাখা সোনালি ঘড়ি। তাতে সময় দেখাচ্ছে ১২টা ৫৭ মিনিট। একদম কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সময়। পাশে খোলা রজতবাবুর বেল্ট। পায়ে জুতো পরানো। দেহের কিছু অংশ উদ্ধার করে ময়না-তদন্তের জন্য পাঠানো হয় বসিরহাট জেলা হাসপাতালে।
বাবার দেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন রণিতা। স্বান্তনা দিচ্ছিলেন তাঁর বন্ধু সৌনক দাশগুপ্ত। চোখে জল নিয়ে রনিতা বলেন, ‘‘ওদেরও তো বাড়িতে বাচ্চা আছে। এমন নৃশংস ভাবে কী করে কাউকে খুন করতে পারে!” রণিতা জানান, পুলিশের তদন্তের উপরে তাঁদের ভরসা আছে। দোষীদের যেন কঠোর সাজা হয়। বিয়ে করতে চেয়ে পার্থ তাকে নানা সময়ে হুমকি দিত বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্রী রণিতা। ছোট বোন পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। মা গৃহবধূ। বাবাই ছিলেন পরিবারের এক মাত্র উপার্জনকারী।
এ দিন ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাবলুর বড় ছেলে লব। বছর তিরিশের যুবক বলেন, “ভেড়ির ব্যবসা করেন বাবা। কী ভাবে এমন কাজে জড়িয়ে পড়লেন, বিশ্বাসই হচ্ছে না।” বাবলুর স্ত্রী সুলেখাদেবী বলেন, ‘‘এমন ঘটনার পরে কী ভাবে গ্রামে বাস করব জানি না।” টিনের চালের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ডেকরেটর্সের ব্যবসায়ী রণজিতের স্ত্রী শেফালিদেবী বলেন, ‘‘মানুষটা তো এ ক’দিন দিব্যি স্বাভাবিকই ছিলেন। সময় মতো খাওয়া-দাওয়া করেছেন। ব্যবসার কাজ সামলেছেন। কিচ্ছুটি বুঝতে পারিনি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy