Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
ঠাকুরনগর

দুষ্কৃতীদের হামলায় জখম ৩ জন

নিজেদের মধ্যে গোলমালের জেরে এক যুবক পেটাচ্ছিল অন্য জনকে। প্রতিবাদ জানান এলাকারই বাসিন্দা টিটু বিশ্বাস। মারধর করা হয় তাঁকে। ঘটনার দিন কয়েক বাদে, সোমবার টিটুর বাড়িতে হামলা চালায় এক দল দুষ্কৃতী। জখম হয়েছেন টিটু ও তাঁর দুই আত্মীয়। তাঁদের গুলি করে কোপানো হয় বলে বাড়ির লোকের দাবি। মারধর করা হয়েছে এক কিশোরী-সহ পরিবারের কয়েক জন মহিলাকেও। ঘটনাটি ঘটেছে গাইঘাটার ঠাকুরনগরের বড়াকৃষ্ণনগর গ্রামে। সন্ধের মধ্যে ৯ জনকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। আটক করা হয়েছে দু’টি গাড়ি।

রক্তে মাখামাখি ঘর। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

রক্তে মাখামাখি ঘর। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
গাইঘাটা শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৪ ০০:৪৮
Share: Save:

নিজেদের মধ্যে গোলমালের জেরে এক যুবক পেটাচ্ছিল অন্য জনকে। প্রতিবাদ জানান এলাকারই বাসিন্দা টিটু বিশ্বাস। মারধর করা হয় তাঁকে। ঘটনার দিন কয়েক বাদে, সোমবার টিটুর বাড়িতে হামলা চালায় এক দল দুষ্কৃতী। জখম হয়েছেন টিটু ও তাঁর দুই আত্মীয়। তাঁদের গুলি করে কোপানো হয় বলে বাড়ির লোকের দাবি। মারধর করা হয়েছে এক কিশোরী-সহ পরিবারের কয়েক জন মহিলাকেও।

ঘটনাটি ঘটেছে গাইঘাটার ঠাকুরনগরের বড়াকৃষ্ণনগর গ্রামে। সন্ধের মধ্যে ৯ জনকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। আটক করা হয়েছে দু’টি গাড়ি। কিন্তু মূল অভিযুক্ত মৃত্যুঞ্জয় বৈরাগী পলাতক। তার খোঁজ চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

টিটুর সঙ্গে কুখ্যাত দুষ্কৃতী মৃত্যুঞ্জয়দের বিবাদ যে বাড়ছিল, সেই খবর জেনেও পুলিশকে জানাননি বলে অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় ইছাপুর ২ পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য বিনয় দত্তের বিরুদ্ধে। টিটুর পরিবারও তৃণমূল সমর্থক বলেই পরিচিত। তাঁর দাদা লিটন বলেন, “দিন কয়েক আগে আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে বাবাকে শাসিয়েছিল মৃত্যুঞ্জয়। তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিনয়বাবু। তিনি দু’পক্ষকে নিয়ে বসে বিষয়টি মিটমাট করে দেবেন বলেছিলেন। এমনকী, পুলিশ আসার দরকার নেই বলেও জানিয়েছিলেন।” সোমবার বেলা ৩টেয় বিনয়বাবুর বাড়িতে দু’পক্ষের বসার কথাও হয়েছিল। কিন্তু এ দিন বেলা ৩টের কিছু ক্ষণ আগেই আক্রান্ত হন টিটুরা।

বিনয়বাবুর আবার দাবি, টিটুর পরিবারের তরফেই আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলতে তাঁকে মধ্যস্থতা করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু ঘটনার কথা পুলিশকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলেন না কেন? তা নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি ওই পঞ্চায়েত সদস্য। বচসার সময়ে তিনি কারও হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেখেননি বলেই দাবি করেছেন।

মৃত্যুঞ্জয়দের সঙ্গে তৃণমূলের ঘনিষ্ঠতা আছে বলে দাবি করেছেন টিটুর পরিবারের লোকজন। তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এ দিন আরজিকর হাসপাতালে আহতদের দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “দুষ্কৃতীরাই এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। তবে এর পিছনে রাজনৈতিক মদতও থাকতে পারে।” মদতদাতা কারা, তা নিয়ে অবশ্য মুখ খোলেননি মন্ত্রী। কিন্তু তাঁর দলের পঞ্চায়েত সদস্য সব জেনেও চুপ করে বসেছিলেন কেন? জ্যোতিপ্রিয়বাবু বলেন, “বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।”

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, ঘটনার সূত্রপাত কালীপুজোর দিন। ব্যক্তিগত বিবাদের জেরে সে দিন স্থানীয় যুবক রিপন বিশ্বাসকে পেটাচ্ছিল দেবা বৈরাগী নামে এক জন। সে আবার মৃত্যুঞ্জয়ের ভাই। ওই দৃশ্য দেখতে পেয়ে প্রতিবাদ জানান টিটু। দেবা সে সময়ে তাঁকে মারধর করে বলে অভিযোগ। টিটুর পরিবারের দাবি, সে সময়ে দেবা বলেছিল, “কাজটা ভাল করলি না। ফল ভাল হবে না।”

ঘটনা সেখানেই থেমে থাকেনি। দেবা আর তার সঙ্গীসাথীরা টিটুকে টেনে নিয়ে যায় কালীপুজোর মণ্ডপে। সেখানে তাঁকে সারা রাত বসিয়ে রাখা হয়। ভোরের দিকে টিটুর এক মাসি তা দেখতে পেয়ে হইচই শুরু করেন। টিটুর বাবা ভুবন বিশ্বাস, দাদা লিটনরা বেরিয়ে আসেন। তখনকার মতো ছেড়ে দেওয়া হয় টিটুকে। এরপরে ভুবনবাবুরা দেবার বাড়িতে হাজির হন। কেন তাঁর ছেলেকে মারধর করা হয়েছে তা জানতে চান। এই নিয়ে শুরু হয় বচসা। ইতিমধ্যে সেখানে এসে পৌঁছন এলাকার বাসিন্দা পঞ্চায়েত সদস্য বিনয়বাবু। ভুবনবাবুদের অভিযোগ, তাঁর সামনেই আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে শাসানি দেয় দেবার দাদা মৃত্যুঞ্জয়। আলোচনায় গোলমাল মিটিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত হওয়ার পরে ফিরে আসেন সকলে। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “ওই দিনই গাইঘাটা থানায় ফোন করে জানিয়েছিলাম, দুষ্কৃতীরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘুরছে। এক বার আসুন আপনারা। পুলিশ আসবে বলেও আর আসেনি।” টিটুর দাদা লিটন বলেন, “আমরা পরে ঘটনার কথা থানায় লিখিত ভাবে জানিয়েওছিলাম। পুলিশ সময় মতো কাজ করলে এমন ভয়ঙ্কর কাণ্ড এড়ানো যেতে পারত।”

টিটুর পরিবার সূত্রে জানানো হয়েছে, এ দিন বেলা ৩টে নাগাদ দু’টি গাড়ি এবং কয়েকটি মোটর বাইক নিয়ে সেখানে হাজির হয় মৃত্যুঞ্জয় ও তার দলবল। বড় রাস্তার পাশে ইটের সরু পথ ধরে মাঠের এক প্রান্তে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় টিটুদের বাড়ি। রাস্তায় গাড়ি রেখে হেঁটেই এসেছিল সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা। টিটুর মেসো বিধান বিশ্বাসের বাড়িতে ঢুকে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় তারা। কোপানোও হয় তাঁকে। এরপরে দলবল নিয়ে পাশেই টিটুদের বাড়িতে চড়াও হয় মৃত্যুঞ্জয়।

সে সময়ে টিটুর জ্যেঠু বছর ষাটেকের সুমন্তবাবুকে ভাত বেড়ে দিচ্ছিলেন টিটুর মা আরতিদেবী। দুষ্কৃতীরা হামলা চালাতে এসেছে বুঝে একটা ঘরে ঢুকে ভিতর থেকে দরজা আটকে দেন টিটুরা। তাঁর সঙ্গে টিনের দেওয়ালের ঘরে ছিলেন দিদি ফুল, মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ভাগ্নী জ্যোতি ও আর এক আত্মীয় যাদব বিশ্বাস। অভিযোগ, টিনের দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে কাছ থেকে গুলি করা হয় টিটুকে। পরে কোপানোও হয়। মারধর করা হয় বাকিদের। বেরিয়ে আসার সময়ে টিটুর জ্যেঠুকেও গুলি করে কোপায় দুষ্কৃতীরা। বাড়ির অন্য ঘরেও ঢুকে দেখে, আর কেউ আছে কিনা। মিনিট পাঁচ-সাতেকের মধ্যে ‘অপারেশন’ সেরে পায়ে হেঁটে গিয়ে গাড়িতে উঠে এলাকা ছাড়ে হামলাকারীরা। যাওয়ার সময়ে তারা বেশ কয়েক রাউন্ড এলোপাথাড়ি গুলি ছোড়ে বলেও অভিযোগ এলাকার মানুষের।

খবর পেয়ে বনগাঁর এসডিপিও মীর সাহিদুল আলির নেতৃত্বে পুলিশ আসে। দুষ্কৃতীদের খোঁজে বিভিন্ন রাস্তায় নাকাবন্দি করে দেওয়া হয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গোবরডাঙা থেকে ধরা পড়ে ৯ জন। উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, “ঘটনা জানার পরে দ্রুত পদক্ষেপ করা হয়েছে। বাকিরাও শীঘ্রই ধরা পড়বে।”

পুলিশের কাছে মৃত্যুঞ্জয়ের নামে অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ। মধ্যমগ্রাম, লেকটাউন, ঘোলা এলাকায় দুষ্কৃতী হিসাবে ‘নামডাক’ আছে তার। মধ্যমগ্রামে জোড়া খুনের ঘটনাতেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল। নানা ঘটনায় বেশ কয়েক বার জেলও খেটেছে সে। পুজোর আগে আগেই জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ফিরেছিল এলাকায়।

টিটুদের বাড়িতে দুর্গা পুজো হয়। পুজোর সময়ে কেরল থেকে ফিরেছিলেন বছর সাতাশের ওই যুবক। সেখানে গেঞ্জি কারখানায় কাজ করেন তিনি। এলাকায় ভাল ছেলে হিসাবেই পরিচিতি আছে। এমন একটি পরিবারের উপরে হামলার ঘটনায় ক্ষুব্ধ ও আতঙ্কিত এলাকাবাসী।

বনগাঁ মহকুমায় সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। মাস খানেকের মধ্যে মহকুমায় খুন হয়েছেন দু’জন। বনগাঁর কলমবাগান বাজারে ভরসন্ধ্যায় দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হন সাত্তার মণ্ডল। তাঁরও অপরাধের পুরনো রেকর্ড আছে। ওই ঘটনায় দু’একজন ধরা পড়লেও মূল অভিযুক্তেরা এখনও অধরা। কেন খুন করা হল সাত্তারকে, তা-ও স্পষ্ট ভাবে জানাতে পারেনি পুলিশ।

বাগদার পাকাবাড়ি এলাকায় সম্প্রতি গুলিতে জখম হয়েছেন আরও এক যুবক। টাকা-পয়সা নিয়ে গোলমালের জেরেই তাঁর উপরে হামলা হয় বলে প্রাথমিক তদন্তে জানতে পারে পুলিশ। ওই ঘটনায় গ্রেফতার হয়নি কেউ।

কয়েক দিন আগেই গোপালনগরের খাবরাপোতায় দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হয়েছেন ইউনুস মণ্ডল। গুলিতে জখম হন আরও এক জন। দু’জনকে পুলিশ ধরলেও মূল অভিযুক্তদের এখনও গ্রেফতার করা যায়নি। পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে সেখানে পথ অবরোধও করেন স্থানীয় মানুষজন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অবশ্য বলেন, “প্রতিটি আলাদা ঘটনা। তদন্ত চলছে। অভিযুক্তেরা ধরা পড়বেই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

gaighata 3 injured terrorist attack southbengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE