Advertisement
E-Paper

পর্যটনের পালে হাওয়া লেগে টাকির নাম ছড়িয়েছে রাজ্যে

শোনা যায়, একবার তালুকের কিছু প্রজা খাজনা দিতে বেঁকে বসে। টাকির রায়চৌধুরী জমিদার নদীপথে ৭ নৌকা ভর্তি লাঠি পাঠিয়েছিলেন ওই এলাকায়। তা দেখেই বিদ্রোহী প্রজারা রণে ভঙ্গ দেয়। টাকির হাওয়া-বাতাসে এমন জমিদারি মেজাজের গল্প ভাসে। দেশভাগের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ১৯৪৭ সালের পরে অনেকেই ও পার বাংলা থেকে চলে এসেছিলেন এ পারে। টাকি-হাসনাবাদ-বসিরহাটের নতুন করে সংসার পাতেন তাঁদের অনেকেই।

নির্মল বসু

শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০১৪ ০০:০৮

শোনা যায়, একবার তালুকের কিছু প্রজা খাজনা দিতে বেঁকে বসে। টাকির রায়চৌধুরী জমিদার নদীপথে ৭ নৌকা ভর্তি লাঠি পাঠিয়েছিলেন ওই এলাকায়। তা দেখেই বিদ্রোহী প্রজারা রণে ভঙ্গ দেয়।

টাকির হাওয়া-বাতাসে এমন জমিদারি মেজাজের গল্প ভাসে।

দেশভাগের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ১৯৪৭ সালের পরে অনেকেই ও পার বাংলা থেকে চলে এসেছিলেন এ পারে। টাকি-হাসনাবাদ-বসিরহাটের নতুন করে সংসার পাতেন তাঁদের অনেকেই। তারপর থেকেই টাকির পরিবর্তনেরও শুরু। বিশেষ করে, পর্যটনকে সামনে রেখে দানা বাঁধতে থাকে আধুনিক টাকি শহর।

ইছামতীর ধারে তৈরি হয় পুরসভার গেস্ট হাউস। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে হাসনাবাদ নাইট শেল্টার, নৃপেন্দ্র অতিথিশালা, তিষ্ঠ ক্ষণ কাল, বিধান সৈকত ১ এবং ২ এই সব গেস্ট হাউসে ৭৫টি পরিবারের থাকার মতো জায়গা আছে। এ ছাড়াও, আরও ৫৫ জনের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করেছে পুরসভা। সরকারি ছাড়াও টাকিতে চারটি এবং সোদপুরে একটি গেস্টহাউসে আরও শতাধিক পরিবারের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই সব গেস্টহাউসে সারা বছর পালা করে নানা বাংলা ছবির শু্যটিং হয়। টলিউডের নামজাদা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রায় সকলেরই কোনও না কোনও সময় পা পড়েছে টাকিতে, এ কথা বললে হয় তো অত্যুক্তি হবে না। যা নিয়ে শহরবাসীর গর্বের অন্ত নেই। সাম্প্রতিক সময়ের গয়নার বাক্স, চাঁদের পাহাড়, পাখি, কাগজের নৌকো, অপুর পাঁচালি, গল্প হলেও সত্যির মতো ছবির শু্যটিং হয়েছে টাকিতে। বউ কথা কও, বধূ কোন আলো লাগল চোখের মতো হাল আমলের জনপ্রিয় টিভি সিরিয়ালের শু্যটিংয়ের জন্যও প্রয়োজক-পরিচালকেরা বেছে নিয়েছেন টাকিকেই। এখানকার নৈসর্গিক দৃশ্যে অভিভূত হয়েছিলেন অভিনেতা দেব।

জালালপুরে গড়ে উঠেছে মিনি সুন্দরবন। বেশ কয়েক একর জায়গার উপরে গরান, কেওড়া, গোলপাতা, বাইন, কাঁকাড়া ইত্যাদি গাছ লাগানো হয়েছে। জঙ্গলের মধ্যে যাওয়ার জন্য লম্বা সেতু আছে। জালালপুরেই আছে নন্দদুলালের মন্দির, সোদপুরে জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরীর বাড়ি, পীরের দরগা, পদ্মপুকুর-সংলগ্ন পার্ক। টাকিতে দর্শনীয় স্থানের মধ্যে আছে জোড়া মন্দির, ইছামতীর ধারে বৃদ্ধাশ্রম, বিধান সৈকত। ইছামতীর বুকে লঞ্চ ভাসার ব্যবস্থা আছে। ইকো ট্যুরিজম পার্ক, রামকৃষ্ণ মিশন, হেমন্ত ঘোষাল স্মৃতিসৌধ, সাংস্কৃতিক মঞ্চ-সহ আরও অনেক কিছু। গেস্টহাউসে শুয়ে বসে দু’চারটে দিন আরাম করার পাশাপাশি এ সব জায়গায় ঘুরেও দিব্যি সময় কাটানো যেতে পারে। আর টাকি যদি আসবেনই, তবে এখানকার ভুবন-ভোলানো মালপো আর পাটালির স্বাদ না নিয়ে কী করে খুশি মনে ফিরবেন পর্যটকেরা!

গোটা রাজ্য যখন অপেক্ষা করে থাকে বাঙালির সব থেকে বড় পার্বন দুর্গাপুজোর জন্য, টাকির মানুষ কিন্তু তাকিয়ে থাকেন ভাসানের দিকে। ইছামতীতে ভাসান দেখতে গোটা রাজ্যের ভিড় ভেঙে পড়ে টাকিতে। ওই দিন ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সীমান্ত এলাকায় নজরদারি অনেকটাই শিথিল থাকে। দু’দেশ থেকে নৌকো করে প্রতিমা এসে নিরঞ্জন দেওয়া হয় নদীতে। দু’পাড়ে দাঁড়িয়ে তো বটেই, জলবিহার করতে করতেও অসংখ্য মানুষ সেই দৃশ্যের সাক্ষী থাকেন। সৌহার্দ্যের এক অনন্য নজির তৈরি হয় এই দিনটিতে, যা নিয়ে টাকির মানুষ গর্বিত।

টাকি-হাসনাবাদে শতাধিক দুর্গাপুজোও হয়। শঙ্কর রায়চৌধুরী, জমিদারদের পূবের বাড়ি, সূর্যকান্ত রায়চৌধুরী এবং প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের বাড়িতে প্রাচীন রীতিনীতি মেনে পুজো হয়। এক সময়ে এই সব জমিদার বাড়িতে দুর্গাপুজোয় বলির জন্য বাংলাদেশের সাতক্ষিরা থেকে নৌকো ভর্তি করে ছাগল আসত। মার্টিন রেলে করে মহিষও আনা হত। পুজো দেখতে সে সময়ে সুন্দরবন এলাকা-সহ শহর কলকাতা থেকেও মানুষ আসতেন এই এলাকায়।

টাকিতে একাধিক জমিদার পরিবার বসবাস করায় এক সময়ে খুবই বর্ধিষ্ণু ছিল এই এলাকা। মূল কর্মসংস্থান ছিল চাষবাস। সেই সঙ্গে ব্রিটিশদের নুনের কারবারের সুবাদে ধনী ব্যবসায়ী শ্রেণিও গড়ে ওঠে এখানে। পরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চাকুরিজীবীর সংখ্যা বেড়েছে। বহু জ্ঞানীগুণী মানুষের আনাগোনায় আরও সমৃদ্ধ হয়েছে এলাকায়। উন্নয়নের ধারার নিরিখেও গত কয়েক বছরে টাকি বেশ চোখে পড়ার মতো।

টাকি ষষ্ঠীবর লালমাধব উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মনীষা মুখোপাধ্যায় বলেন, “টাকির মানুষের ভাল দিক হল, তারা কখনও উন্নয়নের কাজে রাজনীতির মেরুকরণ করে না। টাকি পুরসভা এলাকায় একটিও কাঁচা রাস্তা নেই।” গ্রন্থাগারিক অধীর পাল বলেন, “এক সময়ে মহকুমার বিভিন্ন প্রান্তে যাতায়াতের একমাত্র উপায় ছিল নৌকো। পরে রাস্তাঘাট তৈরি হল। কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ল। পর্যটনের জন্যও আর্থিক ভাবে উপকৃত হয়েছেন এখানকার অনেক মানুষ।”

এক সময়ে টাকি পুরসভায় এসেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রসরাজ অমৃতলাল বসু, জলধর সেন। বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে একবার রাজ্যের সব মন্ত্রীদের নিয়ে ‘আম দরবার’ বসেছিল টাকিতে। টাকির আদি বাসিন্দা পরমাণু বিজ্ঞানী শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা ক্রিকেট দলের অন্যতম সদস্য দুর্গাশঙ্কর মুখোপাধ্যায়, দিল্লির জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশিস দত্ত, প্রাক্তন সেনাধ্যক্ষ শঙ্কর রায়চৌধুরী প্রমুখ। ভারত সরকারের জেনারেল অ্যাটর্নি ছিলেন স্যর অশোককুমার রায়। তাঁর বাড়িও টাকিতেই।

(চলবে)

torism at taki taki getting famous of tourism taki nirmal basu southbengal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy