Advertisement
E-Paper

রাজনীতির টানাপড়েনে ক্ষুণ্ণ বহু মতুয়া

অতীতে এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন কখনও হতে হয়নি মতুয়া ভক্তদের। তাঁদের পরম শ্রদ্ধেয় ঠাকুরবাড়ির দুই সদস্য এ বার জড়িয়ে পড়েছেন ভোটের লড়াইয়ে। স্বাভাবিক ভাবেই যা অস্বস্তির কারণ হিসাবে দেখা দিয়েছে মতুয়া ভক্তদের কাছে। ঠাকুর পরিবারের দুই সদস্যকে ঘিরে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক বিভাজন প্রভাব ফেলছে মতুয়াদের মধ্যেও। তাঁরা ভোট-বাক্সে শ্যাম রাখবেন না কূল, তা নিয়ে এখনও দ্বিধাবিভক্ত। আবার মতুয়া-বাড়ির এই রাজনৈতিক মেরুকরণকে ভাল চোখে দেখছেন না ভক্তদের একটা বড় অংশ।

সীমান্ত মৈত্র

শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:৩০

অতীতে এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন কখনও হতে হয়নি মতুয়া ভক্তদের।

তাঁদের পরম শ্রদ্ধেয় ঠাকুরবাড়ির দুই সদস্য এ বার জড়িয়ে পড়েছেন ভোটের লড়াইয়ে। স্বাভাবিক ভাবেই যা অস্বস্তির কারণ হিসাবে দেখা দিয়েছে মতুয়া ভক্তদের কাছে। ঠাকুর পরিবারের দুই সদস্যকে ঘিরে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক বিভাজন প্রভাব ফেলছে মতুয়াদের মধ্যেও। তাঁরা ভোট-বাক্সে শ্যাম রাখবেন না কূল, তা নিয়ে এখনও দ্বিধাবিভক্ত। আবার মতুয়া-বাড়ির এই রাজনৈতিক মেরুকরণকে ভাল চোখে দেখছেন না ভক্তদের একটা বড় অংশ। এই পরিস্থিতি তাঁরা কোনও বাড়তি সুবিধা পান কিনা, তা নিয়ে জল্পনা চলছে বাম শিবিরে।

অতীতে ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা তথা মতুয়াদের ধর্মগুরু প্রমথরঞ্জন ঠাকুর ভোটে দাঁড়িয়ে জিতে বিধায়ক, মন্ত্রী ও সাংসদ হয়েছিলেন। তিনি বিধায়ক হয়েছিলেন কংগ্রেস থেকে দাঁড়িয়ে। সাংসদ হয়েছিলেন বাংলা কংগ্রেসের প্রার্থী হিসাবে। পরে অবশ্য ফের কংগ্রেসে ফিরে এসেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর ছোট ছেলে মঞ্জুলকৃষ্ণ তৃণমূলের টিকিটে দাঁড়িয়ে জিতে মন্ত্রীও হন। গত লোকসভা ভোটে তৃণমূল প্রার্থী করেছিল সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি তথা মঞ্জুলের দাদা কপিলকৃষ্ণকে। মতুয়া ভোটব্যাঙ্কও অকাতরে ঘাসফুলের পক্ষেই রায় দিয়েছিল ইভিএমে। যার ভরসায় একের পর এক ভোটে কিস্তিমাত করেছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

কিন্তু এ বার পরিস্থিতি আলাদা। মঞ্জুলকৃষ্ণ ইতিমধ্যেই মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিয়ে বিজেপি শিবিরে। তাঁর ছেলে সুব্রতও তৃণমূল ছেড়ে যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে। এ বার বনগাঁ কেন্দ্রে সুব্রতকেই তুরুপের তাস করেছে বিজেপি। অন্য দিকে, তৃণমূলের টিকিটে ভোটে লড়ছেন প্রয়াত সাংসদ কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরের স্ত্রী মমতা। জেঠিমা-ভাইপোর লড়াই সরাসরি এসে পড়েছে ভোটের ময়দানে। সেই সূত্রেই সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের প্রধান উপদেষ্টা বীণাপাণি ঠাকুরের (বড়মা) সংসারে রাজনৈতিক বিভাজনের ছবিটা আরও স্পষ্ট হয়েছে। দ্বিধাবিভক্ত মতুয়া ভক্তেরাও।

এই পরিস্থিতিতে মতুয়া ভোট যে ভাগাভাগি হবেই, তা এক রকম নিশ্চিত। মতুয়াদের একটা অংশ জানাচ্ছেন, তাঁরা কোন শিবিরে যাবেন তা নিয়ে তাদের ভিন্ন ভিন্ন মত থাকলেও এটা ভেবে তাঁরা গর্বিত হচ্ছেন যে তাদের পরম শ্রদ্ধেয় ঠাকুরবাড়ি থেকেই দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রার্থী মনোনীত হয়েছেন। মতুয়া ভক্তদের এই অংশের কথায়, “এটাও কি কম বড় পাওনা? এর থেকে প্রমাণ হয়, ভোটবাক্সে মতুয়াদের গুরুত্ব কতটা।”

কিন্তু ভিন্ন মতও আছে। ঠাকুরনগরের বাসিন্দা, মতুয়া ধর্মপ্রচারক রবি হালদার যেমন বলেন, “ঠাকুর পরিবারের সদস্যদের আমরা ঠাকুর হিসাবে মানি। ওঁরা রাজনীতি করতেই পারেন। কিন্তু ওঁদের নিজেদের মধ্যে কোন্দল আমাদের ভাল লাগছে না। এ বার আমরা ঠাকুর পরিবারের সদস্যদের দেখে নয়, আমরা আমাদের নিজেদের রাজনৈতিক মতাদর্শ অনুযায়ী ভোট দেব।” তবে রবিবাবুর সংযোজন, “তবে বড়মা যদি নির্দিষ্ট কোনও প্রার্থীকে ভোট দিতে বলেন, তা হলে অবশ্য মতুয়াদের একটা অংশ এখনও সেই প্রার্থীকেই ভোট দেবেন।”

দীর্ঘদিন ধরেই মতুয়াদের মধ্যে সব রাজনৈতিক দলেরই নেতা-কর্মী-সমর্থক আছেন। নির্বাচনে তারা তাঁদের রাজনৈতিক মতাদর্শ অনুযায়ী ভোট দিয়ে এসেছেন। ২০০৮ সালে রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে পর্যন্ত মতুয়াদের একটা বড় অংশের সমর্থন বামেরা পেয়ে এসেছে। ঠাকুর পরিবার থেকে কাকে ভোট দিতে হবে এমন কোনও নির্দেশ গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। সে সময় থেকেই বড়মা তৃণমূল প্রার্থীদের ভোটে জেতানোর আবেদন জানিয়ে এসেছেন। তার সুফলও তৃণমূল পেয়েছে।

কিন্তু এ বার কী হবে? বড়মা কোন দিকে যাবেন? তিনি অবশ্য ইতিমধ্যেই মমতাকে ভোটে জয়ী করার আহ্বান জানিয়ে রেখেছেন। সুব্রতর আবার পাল্টা দাবি, বড়মা সকলেরই বড়মা। সুব্রতকেও আশীর্বাদ করেছেন তিনি।

মতুয়া মহাসঙ্ঘের বনগাঁ মহকুমা কমিটির সম্পাদক মনোজ টিকাদার বলেন, “মতুয়াদের নিজস্ব একটা ভোটব্যাঙ্ক রয়েছে মহকুমায়। মতুয়াদের ১৪০০ দলপতি আছেন। আগে ভোটের সময়ে দেখা গিয়েছে, মতুয়া মহাসঙ্ঘের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে মতুয়াদের কাছে বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, কোন প্রার্থীকে সমর্থন করতে হবে। এ বার যেহেতু সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘ দু’টি, সে কারণে নির্দিষ্ট একটি বার্তা মতুয়াদের কাছে পৌঁছনো সম্ভব নয়। সে কারণে মতুয়া ভোট বিভক্ত হবেই।” ভোট রাজনীতির স্বার্থে ঠাকুরবাড়ির ওই বিভাজন মতুয়া ভক্তদের কাছে অত্যন্ত বেদনাদায়ক বলেই মনে করছেন মনোজবাবু।

প্রসঙ্গত, গত ১৩ অক্টোবর কপিলবাবুর মৃত্যুর পরে সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘ ভেঙে দু’টি মহাসঙ্ঘ গঠিত হয়েছে। একটির সঙ্ঘাধিপতি হয়েছেন মমতা। অন্যটির মঞ্জুল। এই পরিস্থিতি মতুয়াদের ইতিহাসে আগে ঘটেনি। দু’টি কমিটিকেই অবশ্য অনুমোদন দিয়েছেন বড়মা। কিন্তু মতুয়ারা দু’টি শিবিরে বিভক্ত হয়ে গিয়েছেন।

প্রার্থীরা অবশ্য মতুয়া ভোট ভাগভাগির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে নারাজ।

বিজেপি প্রার্থী তথা সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বলছেন, “আমরা মনে হয় না মতুয়া ভোট ভাগ হওয়ার কোনও সম্ভাবনা আছে।” তাঁর দাবি, “মতুয়ারা এখন সমাজে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা শিক্ষিত হয়েছেন। তাঁরাই ভাল-মন্দ বিচার করবেন। মূল্যায়নের দায়িত্ব তাঁদের উপরেই ছেড়ে দিয়েছি।” সুব্রতর মতে, মতুয়ারা সব সময় চান, শিক্ষিত-বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। যিনি নাগরিকত্বের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করতে পারেন। বিজেপির প্রার্থীর কথায়, “সে ক্ষেত্রে মতুয়া ভোট আমার দিকেই থাকবে।”

মমতাদেবীরও দাবি, মতুয়া ভোট ভাগ হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। পাশাপশি সংগঠিত ভোটব্যাঙ্ক তাঁর দিকেই থাকবে বলে মনে করেন তৃণমূল প্রার্থী। তাঁর কথায়, “ভোট পেতে হলে গ্রহণযোগ্যতা লাগে। আর মতুয়াদের মধ্যে সুব্রতর কোনও গ্রহণযোগ্যতা নেই।” জেলা তৃণমূল সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের কথায়, “মতুয়াদের ভাবাবেগ আমাদের সঙ্গেই আছে। কারণ মতুয়ারা জানেন, তাঁদের ও ঠাকুরবাড়ির প্রকৃত উন্নয়ন করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বড়মাকে তিনি মায়ের মতো দেখেন। বড়মাও তাঁকে মেয়ের মতো মনে করেন।”

দুই যুযুধান শিবির যাই বলুক না কেন, মতুয়া সমাজ ও রাজনৈতিক মহল মনে করছেন, মতুয়াদের মধ্যে মমতা বা সুব্রত দু’জনেরই অনুগামী রয়েছেন। আর একটি অংশ আছেন, যাঁরা ঠাকুরবাড়ির ভাঙন মেনে নিতে পারেননি। ভোটের রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত না হয়ে নিজেদের অধিকার রক্ষার প্রয়োজনে মতুয়ারা নিজেরাই প্রার্থী দিতে পারতেন বলে মনে করেন মতুয়াদের এই অংশটি।

সিপিএম প্রার্থী দেবেশ দাস যে কারণে বলেন, “মতুয়াদের নিয়ে যে রাজনীতি হচ্ছে, তা গত লোকসভার প্রচারেও বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন যা ঘটছে তাতে সাধারণ মতুয়ারা বুঝতে পারছেন, তাঁদের নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে। এই প্রেক্ষিতেই তিনিই মতুয়াদের সমর্থন বেশি করে পাবেন বলে আশা দেবেশবাবুর।

রাজনীতির টানাপড়েন চলবেই। কিন্তু উদ্ভুত পরিস্থিতিতে মতুয়া ভক্তেরা অনেকেই যে ক্ষুণ্ণ, সে কথা বলাইবাহুল্য। নিমাই বিশ্বাস নামে এক মতুয়া ভক্তের কথায়, “ঠাকুরবাড়ি আমাদের কাছে পুণ্যভূমি। এখানে আমরা হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের টানে আসি। কিন্তু আর্থিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে ঠাকুর পরিবারের এই বিভাজন দেখে আমরা কষ্ট পাই।” এক মতুয়া ভক্তের কথায়, “বছর পনেরো আগেও ঠাকুরবাড়িতে সারা বছর যে সংখ্যায় মতুয়ারা আসতেন, এখন ওই সংখ্যাটা অনেক কমে গিয়েছে। যার পিছনে ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের রাজনীতি ঢুকে পড়া ও ঘরোয়া কোন্দল অন্যতম কারণ।”

simanto moitra matua bangaon southbengal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy