Advertisement
E-Paper

সীমান্তের গ্রামে বাংলাদেশি দুষ্কৃতীদের হামলা

ফের এক দল সশস্ত্র বাংলাদেশি দুষ্কৃতী হামলা চালালো সীমান্তের গ্রামে। এ বারের ঘটনাস্থল, বাগদা থানার কুলিয়া এলাকার নাথপাড়া। অভিযোগ, বুধবার গভীর রাতে কোদালিয়া নদী পেরিয়ে বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরা হামলা চালায় চিত্তরঞ্জন সাহার বাড়িতে। পরিবারের সদস্যদের গলায় রাম দা ও ভোজালি ঠেকিয়ে পর পর চারটি ঘরে ঢুকে তারা যথেচ্ছ লুঠপাট চালায়। চিত্তরঞ্জনবাবুকে মারধর করা হয়।

সীমান্ত মৈত্র

শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৪ ০১:৫৬
এই নদী পেরোলেই পা পড়বে ভিনদেশের মাটিতে। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

এই নদী পেরোলেই পা পড়বে ভিনদেশের মাটিতে। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

ফের এক দল সশস্ত্র বাংলাদেশি দুষ্কৃতী হামলা চালালো সীমান্তের গ্রামে।

এ বারের ঘটনাস্থল, বাগদা থানার কুলিয়া এলাকার নাথপাড়া। অভিযোগ, বুধবার গভীর রাতে কোদালিয়া নদী পেরিয়ে বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরা হামলা চালায় চিত্তরঞ্জন সাহার বাড়িতে। পরিবারের সদস্যদের গলায় রাম দা ও ভোজালি ঠেকিয়ে পর পর চারটি ঘরে ঢুকে তারা যথেচ্ছ লুঠপাট চালায়। চিত্তরঞ্জনবাবুকে মারধর করা হয়। বাড়ির লোকেদের হাত-পা-মুখ বেঁধে দুষ্কৃতীরা কয়েক ভরি সোনার গয়না, কয়েক হাজার টাকা, মোবাইল, জামা-কাপড় এমনকী, থালা-বাসনটুকুও নিয়ে নদী পেরিয়ে বাংলাদেশের দিকে ফিরে যায়। সে সময়ে দু’টি বোমাও ফাটায় তারা।

ঘটনার পরে আতঙ্কিত এলাকার মানুষ নিরাপত্তার দাবি তুলেছেন। চিত্তরঞ্জনবাবু ওই মর্মে বাগদা থানায় লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, “একটি ডাকাতির মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করা হয়েছে। দুষ্কৃতীদের ধরতে বিএসএফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।”

চিত্তরঞ্জনবাবুর বাড়ির ঠিক পিছনেই কোদালিয়া নদী। ওপারে বাংলাদেশের মাটিলা গ্রাম। কাঁটাতারের বালাই নেই। নদীই দু’দেশের বিভাজন রেখা। এলাকায় বিএসএফের নজরদারি চোখে পড়ে না। নদীতে জল এখন কোমর সমান। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে দুষ্কৃতীরা রাতের অন্ধকারে হেঁটেই নদী পেরিয়ে নাথপাড়ায় ঢুকে পড়ে। এলাকাটি কার্যত বাংলাদেশি দুষ্কৃতীদের ‘মুক্তাঞ্চলে’ পরিণত হয়েছে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বুধবার রাত ১টা নাগাদ সশস্ত্র এক দল দুষ্কৃতী বাংলাদেশ থেকে নদী পেরিয়ে হানা দেয় পেশায় চাষি ও ভুষিমালের ব্যবসায়ী চিত্তরঞ্জনবাবুর বাড়িতে। পাকা বাড়ি হলেও বারান্দায় কোনও গ্রিল নেই। বাড়িতে চিত্তরঞ্জনবাবু ছাড়া ছিলেন তাঁর স্ত্রী সুমিতাদেবী, ভাইয়ের স্ত্রী আভারানিদেবী ও নব্বই বছরের বৃদ্ধা মা মালতীদেবী। পরিবার সূত্রে জানানো হয়েছে, রাত ১টার সময়ে মালতীদেবী বাথরুমে যাবেন বলে ঘরের বাইরে বের হন। চোখে ঠিক মতো দেখতে পান না বৃদ্ধা। অভিযোগ, দুষ্কৃতীরা তাঁকে উঠোনে ঘিরে ধরে। জানতে চায়, বাড়িতে কে কে আছে। ইতিমধ্যেই অন্য দুষ্কৃতীরা সব কটি আলো নিভিয়ে দেয়। মালতীদেবীর গলায় ভোজালি ঠেকিয়ে তাঁর মেজো ছেলে চিত্তরঞ্জনকে ডাকতে বলা হয়। মালতীদেবী ছেলের ঘরের সামনে গিয়ে ‘চিত্ত’ বলে ডাক দিতেই ছেলে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন। দুষ্কৃতীরা চিত্তবাবুকে ঘিরে ফেলে পিছমোড়া করে হাত-মুখ-পা বেঁধে ফেলে। তার আগে চিত্তবাবুকে দিয়েই তাঁর ভাইয়ের স্ত্রী আভারানিকে ডাকানো হয়। তিনিও দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন। চিত্তবাবুর ঘাড়ে ও পায়ে ভোজালি দিয়ে ঘা মারে দুষ্কৃতীরা। ইতিমধ্যে বেরিয়ে আসেন সুমিতাদেবীও। তাঁকেও বেঁধে ফেলা হয়। পর পর চারটি ঘরে ঢুকে লুঠপাট চালায় দুষ্কৃতীরা। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, ঘরে ঢুকেছিল চার জন। বাইরে ছিল আরও কয়েক জন। রাতেই খবর পেয়ে আধ কিলোমিটার দূরের রনঘাট ক্যাম্প থেকে আসে বিএসএফ। বাগদা থানার পুলিশও পৌঁছয়। দুষ্কৃতীরা অবশ্য তত ক্ষণে সীমান্ত পেরিয়ে পালিয়েছে।

বৃহস্পতিবার এলাকায় গিয়ে কথা হল বাগদা পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ কার্তিক বাইনের সঙ্গে। তিনি বলেন, “মাটিয়া থেকে নদী পেরিয়ে বাংলাদেশের দুষ্কৃতীরা এখানে অবাধে চলে আসে গরু-সহ নানা পাচারের কাজ করতে। অথচ বিএসএফের কোনও নজরদারি নেই এখানে। বহু বার বিএসএফের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে নিরাপত্তা বাড়াতে বলা হলেও, তাঁরা ব্যবস্থা নেননি। গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, ওই এলাকায় প্রায় তিন কিলোমিটার পথে কোনও কাঁটাতার নেই। কয়েক বছর আগে নদী বরাবর জওয়ানেরা পাহারা দিলেও বহু দিন তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অবাধে চলছে গরু ও ধুর (মানুষ) পাচার। শ’য়ে শ’য়ে বাংলাদেশি দুষ্কৃতী যখন তখন ঢুকে পড়ছে এলাকায়।

নদীর ঘাটে গিয়ে দেখা গেল, কাদায় গরু নিয়ে যাওয়ার চিহ্ন স্পষ্ট। এলাকার যুবকেরা জানালেন, রাতে বাড়ির বাইরে বের হতে ভয় পান। ঘরের আলো বন্ধ করে দিতে হুমকি দেয় দুষ্কৃতীরা। এলাকার মানুষজন রাস্তায় বিদ্যুতের খুঁটিতে আলো লাগিয়েছিলেন। বাংলাদেশি পাচারকারীরা তা ভেঙে দিয়েছে। এলাকার মানুষের সব থেকে বড় ক্ষোভ, তাদের যাতায়াতের পথে বিএসএফের হাজারটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। পরিচয়পত্র সঙ্গে না থাকলে নানা ভাবে হেনস্থা হতে হয়। অথচ, বাংলাদেশি দুষ্কৃতীদের যাতায়াত বন্ধ করতে পারছে না বিএসএফ। এক বাসিন্দা বললেন, “কিছু দিন আগে নদী বরাবর জওয়ানদের টহল দেওয়ার দাবি জানিয়ে মাইকে প্রচার করা হচ্ছিল। জওয়ানেরা তা দেখতে পেয়ে মাইক আটক করেছিল।” গ্রামে ঢোকার আগে কুলিয়া মোড়ে জওয়ানেরা রাস্তায় পাহারা দেয়।

সাম্প্রতিক সময়ে, বাড়ির উপর দিয়ে গরু পাচারের প্রতিবাদ করায় দু’টি পৃথক ঘটনায় ওই এলাকার বাসিন্দা পরিমল বিশ্বাস ও খগেন বিশ্বাসকে বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরা মারধর করেছিল। চাষিদের কথায়, “খেতের মধ্যে দিয়ে গরু নিয়ে যাবে, অথচ কিছু বলা যাবে না। বললেই কপালে কী আছে কে জানে!” চিত্তবাবুর ভাই প্রভুরঞ্জনবাবু বলেন, “অতীতে গরু পাচার হত অনেক গোপনে। জওয়ানেরা কড়া পাহারাও দিতেন। রাতে বাড়িতে দরজা-জানালা খুলে রেখে আমরা ঘুমোতাম। বাইরে সাইকেল পড়ে থাকত। এখন চোরাচালান হচ্ছে প্রকাশ্যেই। আমরা সব সময়ে আতঙ্কে থাকি।” এত সহজে দু’দেশের মধ্যে পারাপার করা যায় যেখানে, সেখানে জঙ্গিদের যাতায়াতও অসম্ভব নয় বলে আশঙ্কা বাসিন্দাদের।

পুলিশ জানায়, বাগদা থানা এলাকায় মোট সীমান্ত এলাকা ৫৮ কিলোমিটার। তার মধ্যে কাঁটাতার নেই ১০ কিলোমিটার এলাকায়। দুষ্কৃতীরা তার সুযোগ নেয়। বাগদা থানা থেকে নাথপাড়ার দূরত্ব ৮ কিলোমিটার। তবে সেখানে যেতে হলে পুলিশকেও বিএসএফের অনুমতি নিতে হয়। বিএসএফের পক্ষে অবশ্য গ্রামবাসীদের অভিযোগ স্বীকার করা হয়নি। তাদের দাবি, কুলিয়া-সহ নাথপাড়ায় জওয়ানদের নিয়মিত টহল থাকে। পাচারকারীদের ধরাও হয়। তাদের আরও অভিযোগ, গ্রামবাসীদের অনেকে পাচারকারীদের সঙ্গে যুক্ত।

তবে শুধু বাগদা সীমান্তেই নয়, কয়েক মাস আগে গাইঘাটার আংরাইল সীমান্তেও বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরা ঢুকে এক আরপিএফ জওয়ানকে কুপিয়ে-পিটিয়ে খুন করেছিল। এলাকার মানুষ ভিনদেশি দুষ্কৃতীদের ঢোকা বন্ধ করতে আন্দোলন করেছিলেন। এখন অবশ্য আন্দোলন নেই। দুষ্কৃতীরাও অবাধে ঢুকে পড়ছে আংরাইল সীমান্ত দিয়ে। কিছু দিন আগে পেট্রাপোল সীমান্তের ট্রাক টার্মিনাসেও বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরা হামলা চালিয়েছে। কাঁটাতারহীন উন্মুক্ত সীমান্তের সুযোগে ও ঢিলেঢালা নিরাপত্তার ফাঁক গলে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েক বার বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরা হামলা চালিয়েছে বনগাঁ মহকুমার সীমান্ত-লাগোয়া নানা গ্রামে।

বিএসএফ এবং পুলিশ কড়া না হলে সীমান্তের এই এলাকায় শান্তি ফিরবে না বলে মনে করেন সাধারণ মানুষ। কিন্তু তেমন কোনও উদ্যোগ চোখে পড়ে না। নিরাপত্তাহীনতাকেই যেন নিয়তি ধরে নিয়েছেন গ্রামবাসী।

border bangladeshi criminal simanta moitra bagda southbengal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy