Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
অশোকনগর-কল্যাণগড়

সংস্কৃতি-বিনোদন-খেলাধুলো নিয়ে গর্বের বহু উপাদানই ছড়িয়ে শহরে

দেশভাগের স্মৃতি নিয়ে যে সব উদ্বাস্তু মানুষ বসতি গড়েছিলেন অশোকনগর-কল্যাণগড় এলাকায়, তাঁরাই এখন বদলে যাওয়া সময় আর ঝাঁ চকচকে শহরের সঙ্গে দিব্যি মানিয়ে-গুছিয়ে নিয়েছেন। বছর পঞ্চাশের এক প্রবীণ বাসিন্দা জানালেন, ছোটবেলায় কোনও বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না। রাস্তায় বাতি তো দূরের কথা। সন্ধে নামলেই গোটা এলাকা অন্ধকারে ডুবে যেত। ১৯৭৮ সালে টিভি ছিল হাতেগোনা কয়েকটি বাড়িতে। পেলের খেলা হলে যে বাড়িতে টিভি ছিল, সেখানে জনসভার মতো ভিড় হত। বৃদ্ধ বলে চলেন, “যুবক বয়স থেকে দেখলাম, শহরটা বদলে যেতে শুরু করল। রাস্তা-হাসপাতাল, বিদ্যুৎ, পার্ক, যানবাহন পরিষেবা বাড়তে থাকল।”

শহরের অন্যতম বিনোদন মিলেনিয়াম পার্ক। ছবি: শান্তনু হালদার।

শহরের অন্যতম বিনোদন মিলেনিয়াম পার্ক। ছবি: শান্তনু হালদার।

সীমান্ত মৈত্র
শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৪ ০১:১৭
Share: Save:

দেশভাগের স্মৃতি নিয়ে যে সব উদ্বাস্তু মানুষ বসতি গড়েছিলেন অশোকনগর-কল্যাণগড় এলাকায়, তাঁরাই এখন বদলে যাওয়া সময় আর ঝাঁ চকচকে শহরের সঙ্গে দিব্যি মানিয়ে-গুছিয়ে নিয়েছেন।

বছর পঞ্চাশের এক প্রবীণ বাসিন্দা জানালেন, ছোটবেলায় কোনও বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না। রাস্তায় বাতি তো দূরের কথা। সন্ধে নামলেই গোটা এলাকা অন্ধকারে ডুবে যেত। ১৯৭৮ সালে টিভি ছিল হাতেগোনা কয়েকটি বাড়িতে। পেলের খেলা হলে যে বাড়িতে টিভি ছিল, সেখানে জনসভার মতো ভিড় হত। বৃদ্ধ বলে চলেন, “যুবক বয়স থেকে দেখলাম, শহরটা বদলে যেতে শুরু করল। রাস্তা-হাসপাতাল, বিদ্যুৎ, পার্ক, যানবাহন পরিষেবা বাড়তে থাকল।” বয়স্কেরা অনেকেই জানালেন, উদ্বাস্তু হওয়ার বেদনা, শহরের বর্তমান চালচিত্র দেখে অনেকটাই লাঘব হয়েছে।

বস্তুত উন্নয়নের ধারা বেয়ে শহরের মানুষের কাছে গর্ব করার মতো এখন অনেক কিছু আছে। সহস্রাব্দ বিজ্ঞান উদ্যান মিলেনিয়াম বা সায়েন্স পার্ক (মিলেনিয়াম পার্ক নামেই যা বেশি পরিচিত) অবশ্যই তার এক বড় কারণ। ২০০২ সালের ৪ ডিসেম্বর রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পুরসভার উদ্যোগে তৈরি ওই পার্কের উদ্বোধন করেন। ২৬ বিঘে জমির উপর তৈরি ওই পার্কে এক বার ঢুকলে মন ভাল হয়ে যেতে বাধ্য। রয়েছে পাখিরালয়, সাপ সংরক্ষণ কেন্দ্র। অজগর, গোখরো, কেউটে, কালাচ, চন্দ্রবোড়া নানা ধরনের সাপ দেখা যাবে। পুর কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছে, এলাকার মানুষ এখন আরও কেউ সাপ মারেন না। কোথাও সাপ দেখা গেলে তা ধরে এনে চিকিৎসা করিয়ে ফের বন-জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয়। পার্কে ঢোকার মুখেই পুরসভার উদ্যোগে তৈরি করা হয়েছে সায়েন্স মিউজিয়াম। সেখানে দূরবীন দিয়ে চাঁদ দেখার ব্যবস্থা রয়েছে। তৈরি হচ্ছে বিড়লা তারামণ্ডলের ক্ষুদ্র সংস্করণ। রয়েছে দোলনা, রোপওয়ে, বোটিংয়ের আকর্ষণ। এমন আরও বহু আকর্ষণ ছড়িয়ে আছে পার্ক জুড়ে। ভাড়া পাওয়া যায় গেস্ট হাউস। সপ্তাহের মঙ্গলবার ছাড়া রোজ বেলা আড়াইটে থেকে রাত পৌনে ৮টা পর্যন্ত পার্ক খোলা থাকে। এখানকার রোপওয়ে ৮৪ ফুট উঁচু দিয়ে গিয়েছে। কর্তৃপক্ষের দাবি, যা রাজ্যের মধ্যে সব থেকে উঁচুতে। পুরসভার চেয়ারম্যান সমীর দত্ত বলেন, “বছরে এখানে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ বেড়াতে আসেন জেলা ও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। রক্ষণাবেক্ষণ ও অন্য খরচ বাদ দিয়েও বছরে পুরসভা এই পার্ক থেকে বছরে আয় করে ৩০ লক্ষ টাকা। যা এলাকার উন্নয়নে খরচ করা হয়।”

মিলেনিয়াম সায়েন্স পার্ক তৈরি হওয়ার আগে সাধারণ মানুষের কাছে শহরের আকর্ষণ ছিল সংহতি পার্ককে ঘিরে। এই পার্কটি তৈরি হয় ১৯৯৭ সালে। উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন রাজ্যপাল কেভি রঘুনাথ রেড্ডি। সংহতি পার্কের অতীতের সেই রমরমা ইদানীং কমলেও মানুষের কাছে এখনও তা আগ্রহের বিষয়। টয়ট্রেন, বোটিং-সহ নানা বিনোদনের ব্যবস্থা আছে। আরও আছে যাদুবক্স। আলিবাবা ও চল্লিশ চোরের মতো ‘চিচিং ফাঁক’ বললেই পাহাড়ের মধ্যে থাকা গুহার দরজা খুলে যায়। পুরসভার ভাল আয় হয় এখান থেকেও। কল্যাণগড়ের জগদ্ধাত্রী পুজোও গোটা জেলায় গুরুত্বপূর্ণ। তা নিয়েও বহু মানুষের উৎসাহ আছে। দূর দূর থেকে অনেকে ভিড় জমান পুজোর দিনে।

বিভিন্ন রাস্তায় বসেছে ত্রিফলা লাইট, হাইম্যাক্স লাইন। যা রাতের শহরের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। শহরের রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে বসানো হয়েছে অটোমেটিক সিগন্যাল। গাড়ি চালকেরা অবশ্য তা কতটা মেনে চলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

অশোকনগর স্টেডিয়াম।--নিজস্ব চিত্র।

এখানকার মানুষের আরও একটি গর্বের জিনিস হল সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ‘শহিদ সদন’। ১১০০ আসনের ওই অডিটোরিয়ামের উদ্বোধন হয় ১৯৮৪ সালের ২৭ মে। তৎকালীন পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী প্রশান্ত শূর সেটির উদ্বোধন করেছিলেন। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, বাইরের দেওয়ালের রঙ চটে গিয়েছে। ভিতরে গোবরডাঙার একটি নাট্যদলের সদস্যেরা মহরায় ব্যস্ত ছিলেন। তাঁরা জানালেন, গোবরডাঙায় এই মুহূর্তে কোনও অডিটোরিয়াম বা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র না থাকায় তাঁরা এখানেই নাটক করতে আসেন। অশোকনগর-কল্যাণগড় এলাকায় বেশ কিছু নাটকের দল রয়েছে। সাংস্কৃতিক চর্চা নিয়ে মানুষের মধ্যে আগ্রহও প্রবল। তাঁদের বড় ভরসার জায়গা এই শহিদ সদন। কিন্তু সদনের ভিতরে গিয়ে দেখা গেল, দেখভালের অভাব স্পষ্ট।

সম্প্রতি এলাকার কয়েকটি নাটকের দলের সদস্যেরা মিলে তৈরি করেছেন ‘অশোকনগর নাট্যবন্ধু’ নামে একটি দল। তাদের তৈরি রক্তকরবী পথ নাটকটি এলাকায় সাড়া ফেলেছে। নাট্যবন্ধুর তরফে কৌশিক সরখেল বলেন, “এলাকায় সাংস্কৃতিক চর্চার পরিবেশ ভালই। পুরপ্রধানের দাবি, শহিদ সদনের শব্দ প্রক্ষেপণ ব্যবস্থা উন্নত করা হয়েছে। সদন সংস্কারও হবে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করা হবে সেটি।

রাজ্যের ক্রীড়া মানচিত্রে অশোকনগর-কল্যাণগড় বহু দিন আগেই জায়গা করে নিয়েছে। যার শুরুটা হয়েছিল অতীত দিনের বিখ্যাত ফুটবলার সমরেশ চৌধুরীর হাত ধরে। সমরেশবাবু এখানকার ভূমিপুত্র। অশোকনগর-কল্যাণগড় থেকে বিখ্যাত আরও খেলোয়ার বাংলা উপহার পেয়েছে। তাঁদেরই এক জন অসীম বিশ্বাস। কলকাতার ময়দানে মহামেডানের হয়ে দাপটের সঙ্গে খেলছেন তিনি। জাতীয় দলেও খেলেছেন। এ ছাড়াও শঙ্কর সাধুঁ, লাল বাহাদুর থাপাও মতো ফুটবলারও এখান থেকেই উঠে এসেছিলেন। বাংলা রঞ্জি দলে খেলেছেন কৌশিক ঘোষ। প্রাক্তন রঞ্জি খেলোয়ার শিলাদিত্য মজুমদারও এই শহরের বাসিন্দা। ১৯৫২ সালে তৈরি হয়েছে ‘অশোকনগর স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন’। সংস্থার অধীনে রয়েছে অশোকনগর স্টেডিয়াম। কিছু দিন আগে স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়েছে, ‘বিধানচন্দ্র রায় ক্রীড়াঙ্গন’। সেখানে দু’টি গ্যালারি রয়েছে। এখানে নিয়মিত ভাবে আইএফএ ও সিএবি পরিচালিত নানা খেলার আসর বসে। ফুটবল ও ক্রিকেট কোচিং দেওয়া হয়।

ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক সন্তোষ কর ও সংস্থার প্রাক্তন সম্পাদক রতন চৌধুরী বলেন, “আইএফএ শিল্ডের ক্লাস্টার পর্যায়ের খেলা এখানে হয়েছে। মাঠ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে শ্রমিক দিয়ে ও আর্থিক ভাবে পুরসভা আমাদের সহযোগিতা করে থাকে।” গোটা অশোকনগর-কল্যাণগড় জুড়ে রয়েছে বেশ কিছু ফুটবল ও ক্রিকেট কোচিং সেন্টার। খোখো, ক্যারাটে, জুডো, ব্রতচারী শেখারও ব্যবস্থা আছে। ২০১০ সালের ২১ এপ্রিল একটি মাল্টিজিমের উদ্বোধন করেছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী রেখা গোস্বামী। পুরসভা পরিচালিত ওই আধুনিক মাল্টিজিমে শরীর চর্চার জন্য ছেলে ও মেয়েদের আলাদা ব্যবস্থা আছে। বারাসতের সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদারের সাংসদ তহবিলের ১ কোটি টাকায় ও পুরসভার আর্থিক সাহায্যে তৈরি হচ্ছে দু’টি স্যুইমিং পুল।

দীর্ঘদিন ধরে একটি ক্রিকেট অ্যাকাডেমি চালাচ্ছেন কার্তিক দে। তিনি বললেন, “বহু দিন ধরেই এখানে খেলার পরিবেশ রয়েছে। আমার ক্যাম্পে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও ক্রিকেট কোচিং নিতে আসে। এখানকার ক্লাবগুলোর মধ্যেও ক্রীড়াচর্চার আগ্রহ রয়েছে।” রামকৃষ্ণ সেবা সমিতি-সহ অনেক ক্লাবেই নিজস্ব জিম রয়েছে বলে জানালেন তিনি। এখানকার কল্যাণগড় বিদ্যামন্দির স্কুল সুব্রত কাপে একবার রানার্স হয়েছিল। একবার সেমিফাইনালেও ওঠে। অশোকনগর বয়েজ সেকেন্ডারি স্কুলও একবার সুব্রত কাপের ফাইনাল খেলেছে। হকি-বাস্কেটবলও খেলা হয় বিভিন্ন স্কুলে।

চাষি ও ব্যবসায়ীদের কথা মাথায় রেখে তৈরি হয়েছে ফল ও সব্জি সংরক্ষণের বহুমুখী হিমঘর। খুব শীঘ্রই সেটি চালু হওয়ার কথা। সব্জির পাশাপাশি দুধ-মাছও এখানে রাখা যাবে। কল্যাণগড় বাজার কচুয়া মোড় সহ বিভিন্ন এলাকায় তৈরি হয়েছে সুলভ শৌচাগার। রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্র। দেড়শো বিঘা জমির উপরে তৈরি ওই কেন্দ্রে চাষ-আবাদ ছাড়াও মৎস্য ও পশুপালনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

বাসিন্দারা জানালেন, অতীতে এখানে ‘পূর্ণিমা সম্মেলন’ বলে একটি অনুষ্ঠান হত। সেখানে দেশের বিখ্যাত সব সঙ্গীতশিল্পীরা আসতেন। নট্টপাড়ার বাসিন্দা ক্ষিরোদ নট্ট সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে ঢোল বাজিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও পেয়েছিলেন তিনি। বিখ্যাত নট্ট কম্পানির মালিক মাখনলাল নট্ট এই শহরেরই বাসিন্দা।

এত সবের পরেও অভাব-অভিযোগ কিছু কম নেই। স্বাস্থ্য পরিষেবা, রাস্তাঘাট, নিকাশি নিয়ে ক্ষোভ তো আছেই। তার উপর, এলাকায় কর্মসংস্থানের সমস্যা নিয়েও জেরবার সাধারণ মানুষ। তার উপরে আছে দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE