Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
এক মাসে সাজা, আশ্বাস ছিল মুখ্যমন্ত্রীর

৩০ মাসেও বিচার পায়নি কামদুনি

পার্ক স্ট্রিটের ঘটনায় অপরাধীরা শেষ পর্যন্ত সাজা পাচ্ছে শোনা ইস্তক বৃহস্পতিবার থেকে কেঁদেই চলেছেন এক মহিলা। খাওয়াদাওয়া প্রায় বন্ধ। বিছানা নিয়েছেন। আরও শীর্ণ হয়েছে চেহারাটি। হাতের শিরাগুলো উঁচু হয়ে যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে!

পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ মামলায় দোষীদের শাস্তির খবর দেখাচ্ছে টিভিতে। নিজের বাড়িতে সেই খবর দেখছেন মৌসুমী কয়াল। শুক্রবার কামদুনিতে সুদীপ ঘোষের তোলা ছবি।

পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ মামলায় দোষীদের শাস্তির খবর দেখাচ্ছে টিভিতে। নিজের বাড়িতে সেই খবর দেখছেন মৌসুমী কয়াল। শুক্রবার কামদুনিতে সুদীপ ঘোষের তোলা ছবি।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:১৯
Share: Save:

পার্ক স্ট্রিটের ঘটনায় অপরাধীরা শেষ পর্যন্ত সাজা পাচ্ছে শোনা ইস্তক বৃহস্পতিবার থেকে কেঁদেই চলেছেন এক মহিলা। খাওয়াদাওয়া প্রায় বন্ধ। বিছানা নিয়েছেন। আরও শীর্ণ হয়েছে চেহারাটি। হাতের শিরাগুলো উঁচু হয়ে যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে!

পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ধর্ষণের পরে খুন হয়ে যাওয়া কামদুনির সেই কলেজ পড়ুয়া মেয়েটির মা তিনি। ২০১৩ সালের ৭ জুনের ওই ঘটনার পর রাজ্যজুড়ে হইচই শুরু হয়েছিল। পরিস্থিতির চাপে ঘটনার ১০ দিন পর কামদুনি গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘এক মাসের মধ্যে দোষীরা সাজা পাবে।’’

সেই প্রতিশ্রুতির বয়স আড়াই বছর পেরিয়ে গিয়েছে! এখনও আদালতে চলছে কামদুনি মামলা। পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষণের ঘটনায় শুক্রবার দোষীদের সাজা ঘোষণার পরে কামদুনির মৃতার ছোট ভাইয়ের ক্ষোভ, ‘‘আমার চাকরিটা অস্থায়ী। বাবার চাকরিটাও তাই। না গেলে মাইনে নেই। বাবা চোখে ভাল দেখতে পান না। স্থায়ী চাকরি, উন্নয়ন, দোষীদের এক মাসের মধ্যে সাজা— মুখ্যমন্ত্রীর একটি কথাও রাখা হয়নি!’’

কামদুনি গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি ছিল, ‘‘দোষীরা যাতে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক সাজা পায়, সে জন্য ফাস্ট ট্রাক কোর্টে বিচার করা হবে।’’ এর পরে সিআইডি ৯ জনকে গ্রেফতার করে আদালতে চার্জশিট জমা দেয়। পরে ধৃতদের এক জন জেলে মারাও যায়। এর মধ্যে ৩১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেছে আদালত। তবে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব এখনও শেষ হয়নি।

এর মধ্যেই যেখানে মামলাটির বিচার চলছে, সেই নগর দায়রা আদালতের দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক সঞ্চিতা সরকারের বদলির নির্দেশ এসেছে। মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ পর্বের প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে বিচারক বদলির এই খবরে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে বিচারপ্রার্থীদের। মামলার সরকারি কৌঁসুলি অনিন্দ্য রাউতের কথায়, ‘‘এখন নতুন বিচারক এলে আবার তাঁকে সব সাক্ষীর কথা শুনতে হবে। তাই বিচার শেষ হতে আরও দেরি হয়ে যাবে।’’ কামদুনির ঘটনায় অভিযুক্ত সইফুল আলির স্ত্রী সেলিমা বিবিও হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে বিচারক বদল না করার জন্য আবেদন করেছেন।

২০১৩ সালের ৭ জুন রাজারহাট ডিরোজিও কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রীটির উপর অত্যাচার চালায় দুষ্কৃতীরা। গভীর রাতে মেয়েটির ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ মেলে। তার পরেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন কামদুনির আমজনতা। মুখ্যমন্ত্রীকে ঘটনাস্থলে আসতে হবে, এই দাবি নিয়ে মৃতদেহ আগলে পথ অবরোধ করে বিক্ষোভে নামেন স্থানীয়রা। শাসক দলের সাংসদ-নেতা-মন্ত্রীরা এলে তাঁদের ফিরিয়ে দেন প্রতিবাদীরা। কলকাতা ছাড়াও আশপাশের বহু জেলা এমনকী ভিন্ রাজ্য থেকেও অনেকে এসে দাঁড়ান কামদুনির প্রতিবাদীদের পাশে। গড়ে ওঠে ‘প্রতিবাদী মঞ্চ’। পরিস্থিতির চাপে ঘটনার ১০ দিন পর কামদুনি আসেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে তাঁর কাছে বিচার চাইতে এলে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী ‘মাওবাদী’ তকমা লাগিয়ে দেন গ্রামের বাসিন্দা মৌসুমী কয়াল এবং মৃতার সহপাঠী টুম্পা কয়ালের নামে! মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যে প্রতিবাদীরা আরও তেতে ওঠেন। কলকাতাতেও পথে নামেন অনেক বিশিষ্ট জন। বিচার চাইতে দিল্লি গিয়ে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছেও দরবার করে ‘প্রতিবাদী মঞ্চ’। কামদুনির এই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন পার্ক স্ট্রিটের নির্যাতিতা, প্রয়াত সুজেট জর্ডনও।

এই প্রতিবাদী-আন্দোলনকে ভাঙার জন্য অবশ্য কম চেষ্টা করেনি শাসক দল। আন্দোলন ক্রমশ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে আসরে নেমে মৃতার পরিবারকে সরাসরি মহাকরণে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের আর্থিক সাহায্য, চাকরি-সহ অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাছে টানার পাশাপাশি প্রতিবাদীদের নামে পাল্টা মামলাও করা হয়। একই সঙ্গে ‘প্রতিবাদী মঞ্চে’র পাল্টা একটি ম়ঞ্চ গড়ে এলাকায় ফুটবল প্রতিযোগিতা করে আরও নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ-কাণ্ডের রায় বেরনোর দিনে শাসক দলের নেতাদের সেই সব প্রতিশ্রুতি নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন এলাকার অনেকেই। স্থানীয় এক গৃহবধূর কথায়, ‘‘যেটা আমাদের মূল দাবি ছিল, সেই আলো আজও জ্বলেনি। নতুন রাস্তা গড়া তো দূরের কথা, আগের রাস্তাটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে!’’ স্থানীয়দের অভিযোগ, খারাপ রাস্তার জন্য ক’দিন আগে এক মহিলা পড়ে গিয়ে আহত হয়ে এখন কোমায় রয়েছেন। এক বৃদ্ধের মন্তব্য, ‘‘বাস, গাড়ি কত কিছু চলবে কথা ছিল। কয়েকটি ম্যাজিক-গাড়ি ছাড়া সে সব কিছুই হয়নি!’’

প্রতিশ্রুতি পূরণ না হলেও কামদুনির প্রতিবাদ-আন্দোলন ভাঙতে অবশ্য অনেকটাই সফল শাসক দল। এলাকার এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘এখন সবাই চুপ করে গিয়েছে। পরিবারটিও চাকরি পেয়ে এখান থেকে চলে গিয়েছে। মেয়েটির মৃত্যুর দিনটাতেই শুধু মোমবাতি জ্বেলে মিছিল করে ওরা! শহরের বিশিষ্টদেরও তো আর এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করতে দেখি না!’’

পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের রায় ঘোষণার দিন কামদুনি চুপচাপই। দুপুরে ধর্ষণকারীদের শাস্তির খবর শুনে মৌসুমী কয়াল আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বলেন, ‘‘আমাকে জড়িয়ে ধরে সুজেট বলেছিলেন, ‘পার্ক স্ট্রিটের ঘটনার পর আমি আড়ালে ছিলাম। কিন্তু কামদুনির ঘটনায় তোমাদের এ ভাবে রুখে দাঁড়াতে দেখে ভাবলাম, আমি কেন ঘরে লুকিয়ে থাকব? মুখ্যমন্ত্রীর ধমক খেয়েও তোমরা যে দমে যাওনি, সেই সাহসকেই আমি বুকে জড়াতে এসেছি’।’’ আর টুম্পা কয়ালের কথায়, ‘‘সুজেট একা লড়াই চালিয়ে বিচার পেল। আমার বন্ধুর (কামদুনির নির্যাতিতা) ঘটনায় দোষীদের সাজা কবে হবে কে জানে?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kamduni rape case justice delay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE