Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

থানা-ডাকঘর দৌড়ে টাকা উদ্ধার বৃদ্ধার

ঠোঙা বানিয়ে তিলে তিলে জমানো প্রায় ৩০ হাজার টাকা ডাকঘরের সেভিংস অ্যাকাউন্ট থেকে আচমকাই উধাও হয়ে যায়। টাকা ফেরত পেতে কোমর বেঁধে নামেন উত্তর ২৪ পরগনার জগদ্দলের নারায়ণপুর বালিশখানার বাসিন্দা, কমলারানি চক্রবর্তী।

লড়াকু: জগদ্দলের বাড়িতে স্বামীর পাশে কমলাদেবী। ছবি: সৌভিক দে।

লড়াকু: জগদ্দলের বাড়িতে স্বামীর পাশে কমলাদেবী। ছবি: সৌভিক দে।

সুনন্দ ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭ ০২:৫৭
Share: Save:

বয়সের ভার তাঁকে ন্যুব্জ করতে পারেনি। হাঁটুর ব্যথা মাঝেমধ্যে চাগাড় দিয়েছে, কিন্তু কাবু হননি ৭৩ বছরের বৃদ্ধা। অনটনের সঙ্গে নিত্য ঘরকন্নার ঝক্কিও তাঁকে লড়াইয়ের ময়দান থেকে হটিয়ে দিতে পারেনি।

ঠোঙা বানিয়ে তিলে তিলে জমানো প্রায় ৩০ হাজার টাকা ডাকঘরের সেভিংস অ্যাকাউন্ট থেকে আচমকাই উধাও হয়ে যায়। টাকা ফেরত পেতে কোমর বেঁধে নামেন উত্তর ২৪ পরগনার জগদ্দলের নারায়ণপুর বালিশখানার বাসিন্দা, কমলারানি চক্রবর্তী। তিন বছর ধরে বিভিন্ন ডাকঘরের দরজায় কড়া নেড়েও লাভ না-হওয়ায় মরিয়া হয়েই এক দিন সটান হাজির হন কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাসভবনে।

ডাকঘর কেন্দ্রের অধীনে। তবু মুখ্যমন্ত্রীর দফতর থেকে বিষয়টি দেখতে বলা হয় জগদ্দল থানাকে। রবিবার দাওয়ায় বসে বৃদ্ধা বললেন, ‘‘সুদ-সহ টাকা ফেরত পেয়েছি। পুলিশ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বলেই সেটা সম্ভব হয়েছে।’’

দু’চালার ঘরে কোমর ভেঙে পড়ে আছেন অশীতিপর স্বামী চিররঞ্জন। তিনি সামান্য বেতনের চাকরি করতেন স্বাস্থ্য দফতরে। ছেলে স্থানীয় পুরসভার অস্থায়ী কর্মী। পাঁচ মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পরে দুই মেয়ে দুই সন্তান-সহ ফিরে আসেন বাপের বাড়িতে। এক জনের স্বামী মারা যান। দ্বিতীয় জনকে ছেড়ে চলে যান তাঁর স্বামী। এতগুলো পেটে দানাপানি দিতে আর স্বামীর চিকিৎসার খরচ জোগাতে মেয়েদের নিয়ে ঠোঙা আর পুঁতির গয়না তৈরির কাজে নামেন বৃদ্ধা। একটু একটু করে জমাতেও শুরু করেন ডাকঘরে।

কমলাদেবী জানান, ২০১৩-র ডিসেম্বরে স্থানীয় নারায়ণপুর উপ-ডাকঘর থেকে তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে পাসবই জমা নেওয়া হয়। জানতে পারেন, জমা রাখা ৮০ হাজার ৫৯৫ টাকার মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার টাকা ডাকঘরে নাকি জমা পড়েনি! যদিও প্রতি বারেই তিনি যখন টাকা জমা দিয়েছেন, তার অঙ্ক লিখে ডাকঘর থেকে স্ট্যাম্প মেরে দেওয়া হয়েছে। কাঁকিনাড়া, কাঁচরাপা়ড়া, ব্যারাকপুর ডাকঘরে খোঁজ নেন বৃদ্ধা। সুরাহা হয়নি। এক বার তাঁকে দিয়ে একটি ফর্ম পূরণ করানো ছাড়া কিছুই করেনি কেউ। ২০১৫ সালে জগদ্দল থানায় নারায়ণপুর উপ-ডাকঘরের এক গ্রামীণ ডাকসেবকের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়। অভিযোগ, কমলাদেবী-সহ বেশ কিছু গ্রাহকের টাকা নিয়ে খাতায় স্ট্যাম্প মারার পরেও যথাস্থানে জমা না-দিয়ে সেই টাকা পকেটস্থ করেছেন ওই কর্মী। তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।

আরও পড়ুন: মেয়ের শোকে মৃত্যু মায়েরও, স্তব্ধ প্রৌঢ়

‘‘হাঁটুর ব্যথা নিয়ে বাসে-ট্রেনে-অটোয় ঘুরে বেড়িয়েছি। ২০১৫-য় নতুন পাসবই দিয়ে বলা হয়, আমার নামে ৫০ হাজার টাকার মতো রয়েছে। সেই টাকা তুলিনি,’’ বলেন কমলাদেবী। চলতি বছরের গোড়ায় দুই আত্মীয়কে নিয়ে বৃদ্ধা হাজির হন মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে। কমলাদেবীর কথায়, ‘‘আমাকে জগদ্দল থানার বড়বাবু সঞ্জীব চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করতে বলা হয়েছিল। তার পর থেকে পুলিশ আমার সঙ্গে ঘুরতে শুরু করে। এমনকী এক সময়ে আমি থাকতাম বাড়িতে আর আমার হয়ে ডাকঘরে যেতেন পুলিশ অফিসারেরা।’’ ব্যারাকপুর প্রধান ডাকঘর থেকে কমলাদেবীর ফাইল কলকাতায় যোগাযোগ ভবনে পাঠানো, সেই ফাইল ব্যারাকপুরে ফিরিয়ে আনার মতো খুঁটিনাটি কাজ শেষ করে এই ডিসেম্বরেই উধাও হয়ে যাওয়া টাকা সুদ-সহ ফেরত পেয়েছেন বৃদ্ধা। রবিবার পাসবই খুলে দেখান, সেখানে জমার ঘরে ৯৯ হাজার টাকা।

কলকাতার চিফ পোস্টমাস্টার জেনারেল অরুন্ধতী ঘোষ জানান, গ্রামগঞ্জের দিকে বহু গ্রাহক নিজে ডাকঘরে না-গিয়ে এজেন্ট মারফত টাকা জমা দেন। অনেক ক্ষেত্রেই প্রতারিত হন তাঁরা। ‘‘অন্যের হাতে টাকা দিতে বারবার নিষেধ করেছি আমরা। কেউ প্রতারণা করলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়,’’ দাবি অরুন্ধতীদেবীর।

কমলাদেবী অবশ্য জানান, তিনি নিজে গিয়ে সরাসরিই ডাকঘরে টাকা জমা দিতেন। তা সত্ত্বেও সেই টাকা যে অনেক সময়েই ডাকঘরের ভাঁড়ার পর্যন্ত পৌঁছত না, হাড়ে হাড়ে তা টের পেয়েছেন তিনি। আবার খোয়ানো টাকা যে লড়াই করে ফিরিয়ে আনা যায়, তারও প্রমাণ তিনিই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

money Elderly Bank Harassment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE