Advertisement
E-Paper

হাসপাতালের বেঞ্চই ঘর প্রতাপের

জরুরি অপারেশন হলেও অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই। বাঁচতে চাওয়ার লাইনের খোঁজ নিল আনন্দবাজার। জরুরি অপারেশন হলেও অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই। বাঁচতে চাওয়ার লাইনের খোঁজ নিল আনন্দবাজার।

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৮ ০৫:০১
অপেক্ষা: দু’টো পা-ই অচল ২৬ বছরের প্রতাপ বিশ্বাসের। তাঁর দিন কাটছে বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস-এর বেঞ্চে। নিজস্ব চিত্র

অপেক্ষা: দু’টো পা-ই অচল ২৬ বছরের প্রতাপ বিশ্বাসের। তাঁর দিন কাটছে বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস-এর বেঞ্চে। নিজস্ব চিত্র

হাসপাতালই ঘরবাড়ি!

অক্টোবর থেকে জুন। ছেলের চিকিৎসার সুযোগ পেতে এত বার ডায়মন্ড হারবারের গ্রাম থেকে কলকাতার বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস-এ ছুটতে হয়েছে রামকান্ত বিশ্বাসকে, যে ২৬ বছরের ছেলে প্রতাপকে হাসপাতালে রেখেই বাড়ি ফিরে গিয়েছেন তিনি। তার পর থেকে আউটডোরের অদূরে একটি বেঞ্চই প্রতাপের ঘরবাড়ি। হাঁটতে পারেন না। দয়া করে যে যা দেয়, তাতেই পেট ভরাতে হয়। ঘুম থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক কাজ, সব করতে হচ্ছে ওই বেঞ্চে শুয়ে-বসেই। লোকজন তাঁকে দেখে বিরক্ত হচ্ছেন, গালিগালাজ করছেন, সবটাই মুখ বুজে হজম করতে হচ্ছে।

হাসপাতাল সূত্রের খবর, প্রতাপের দু’টো পা-ই অসাড় হয়ে গিয়েছে। আগে এক বার অস্ত্রোপচার হয়েছে। এখন দ্রুত এবং টানা ফিজিওথেরাপি প্রয়োজন। রামকান্তবাবু বলছেন, ‘‘সামান্য সাইকেলের দোকানে কাজ করি। ফিজিওথেরাপি করানোর টাকা নেই। ছ’মাস ধরে বারবার হাসপাতাল-ঘর করছি। এখন ওকে হাসপাতালে রেখেই গ্রামের বাড়িতে টাকার ব্যবস্থা করতে এসেছি। হাসপাতাল না দেখলে ছেলেটা পঙ্গু হয়ে যাবে।’’

অক্টোবর থেকে জুন— প্রতি সপ্তাহের শুরুতে হাসপাতালে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকেন রাজলক্ষ্মী ধারা। যদি কোনও মতে তাঁর চোট পাওয়া মেরুদণ্ডে অস্ত্রোপচারের জন্য ভর্তির সুযোগ মেলে। কাকদ্বীপের ভুবন নগর থেকে কলকাতায় অসুস্থ শরীরে আসতে গাড়িভাড়াও বিস্তর। কিন্তু উপায় নেই। ডাক্তারবাবুরা বলেছেন, ‘সোমবার আসুন! যে সোমবার বেড খালি থাকবে, ভর্তি হবেন।’ বললেন, ‘‘এক দিন একটা লোক লাইনে এসে বলেছিল, ৩০ হাজার টাকা দিলে ভর্তি করিয়ে দেবে। অত টাকা থাকলে কি এ ভাবে কষ্ট করতাম?’’ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন প্রৌঢ়া।

স্বাস্থ্যকর্তাদের বড় অংশই মানছেন, রাজ্যে স্নায়ু চিকিৎসার একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সরকারি কেন্দ্র— বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস (বিআইএন)-এ অপেক্ষাই বহু রোগীর ক্ষেত্রে শেষ কথা। ঠিক যে ভাবে শেষ হয়ে গিয়েছিল ৪০ বছরের অমিত মণ্ডলের জীবন। অমিতের মস্তিষ্কে জটিল অস্ত্রোপচারের জন্য স্টেন্ট, কয়েলের মতো নানা সরঞ্জাম দরকার ছিল। সরকারি হাসপাতালে যা বিনামূল্যেই পাওয়ার কথা। অথচ অমিতের মা ঝর্ণাদেবীর অভিযোগ, ওই হাসপাতালের স্টোর কিপার পলাশ দত্ত তাঁদের থেকে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা চেয়েছিলেন। টাকা না মিললে আবেদনের ফাইল উপরমহলে না পাঠানোর হুমকিও দেওয়া হত।

প্রশ্ন উঠছে, আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভর্তি থাকা রোগীর চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় জিনিস কেন মিলছে না, তা নিয়ে হাসপাতালের ডিরেক্টর কিংবা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক কেন উদ্যোগী হননি? এ ব্যাপারে তাঁরা কোনও কথাই বলতে চাননি। ঠিক যেমন কথা বলতে চাননি নিরন্তর অপেক্ষা এবং অপেক্ষা করতে করতে রোগীর মৃত্যুর ঘটনা নিয়েও।

বিআইএন-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত এসএসকেএম-এর অধিকর্তা অজয়কুমার রায়কে যত বারই ফোন করা হয়েছে, তিনি বলেছেন, ‘‘মিটিংয়ে ব্যস্ত রয়েছি।’’ নীরব স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষ কর্তারাও। হাসপাতালের এক প্রবীণ চিকিৎসক বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী যতই ফ্রি চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন, নিচুতলায় সদিচ্ছা না থাকলে যে সবই অর্থহীন, এখানে এলেই তা টের পাওয়া যায়।’’

১৯৮টি শয্যা রয়েছে এখানে। আইসিইউ-এ শয্যা সংখ্যা আট। এক চিকিৎসক বললেন, ‘‘একটা টিউমারের অস্ত্রোপচারের পরেই রোগীকে আইসিইউ-এ রাখতে হয়। বেড না থাকলে ভর্তি নেব কী করে? চিকিৎসকের সংখ্যাও তো বাড়ছে না। সরকারকে গোড়া থেকে সমস্যার সমাধানের কথা ভাবতে হবে।’’

ফল? নদিয়া থেকে আসা ইতিকা রায়ের হয়ে হাসপাতালের বহির্বিভাগে লাইন দিয়েছেন স্বামী আশুতোষ। জানালেন, স্ত্রী সোজা হয়ে বসতে পারেন না। বললেন, ‘‘শিরদাঁড়ায় অস্ত্রোপচার করাতে হবে। কিন্তু গত দু’মাস ধরে বেড নেই বলছে। লাইনে দাঁড়িয়েই সব শেষ হয়ে যাবে!’’

(চলবে)

Medical Negligence Bangur Institute of Neurosciences Pratap Biswas
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy