ভূগর্ভস্থ জলের সঙ্কট বাড়ছে। কোথাও জলস্তর নামছে, কোথাও জলে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক, ফ্লোরাইডের মতো পানের অযোগ্য পদার্থ মিশছে। ভূগর্ভস্থ জল তুলে চাষ করতে চাষিদের খরচ বাড়ছে। অথচ, সে তুলনায় ফসলের দাম মিলছে না। চাষে কী ভাবে ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার কমানো যায়, বাঁকুড়া জেলার ১২টি ব্লকে ‘পাইলট প্রজেক্ট’ চালিয়ে সে বিষয়ে দিশা দিচ্ছেন আইআইটি-র (বম্বে) সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, গবেষক সুবিমল ঘোষ। তাঁকে সহায়তা করেছেন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মিটিয়োরোলজির (আইআইটিএম-পুণে) জলবায়ু গবেষকেরা।
গবেষণা বলছে, খরাপ্রবণ এলাকায় চাষিরা জলের অভাবে নানা প্রতিকূলতায় পড়েন। সেচের জন্য তাঁদের নিত্য পরিকল্পনা করতে হয়। এই সব এলাকায় ভূগর্ভস্থ জল দিন দিন কমতে থাকে। চাষিরা যদি আগে থেকে জানতে পারেন, আগামী দিনগুলিতে বৃষ্টির জল কতটা পাবেন, তা কী ভাবে ব্যবহার করা যাবে, তবে পরিকল্পনা করে ভূগর্ভস্থ জল সংরক্ষণ করা যাবে।
উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুরের বাসিন্দা, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী সুবিমল বলেন, “আমরা প্রথমে মহারাষ্ট্রের নাসিকে আঙুর চাষের উপরে গবেষণা করেছিলাম। সেখানে সফল হওয়ার পরে, বাঁকুড়া জেলায় গবেষণা করি। আবহাওয়ার পূর্বাভাস, মাটির আর্দ্রতা পরীক্ষা ও উপগ্রহ চিত্র কাজে লাগিয়ে অন্তত ১৫ দিন আগে বৃষ্টির ছবি চাষিদের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। তাতে ১০-৩০% জলের অপচয় কমবে। যাকে আমরা ‘ওয়েদার স্মার্ট ইরিগেশন মডেল’ বলছি।” গবেষকেরা ভুট্টা, গম, সূর্যমুখী, বাদাম ও তৈলবীজ চাষে ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। আইআইটিএমের বিজ্ঞানী অতুল সহায় বলেন, “এটি একটি পাইলট প্রজেক্ট। বড় পর্যায়ে ধান চাষ নিয়েও গবেষণা করা সম্ভব হবে।”
রাজ্য কৃষি দফতরের দাবি, এ রাজ্যে ভুট্টা চাষ হয় প্রায় ৩.৬২ লক্ষ হেক্টর জমিতে, তৈলবীজ ১.২ লক্ষ হেক্টর, গম ২.২ লক্ষ হেক্টর এবং বাদাম চাষ হয় প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে। আখ ও সূর্যমুখী চাষ বেশি হয় না। মূলত এই চাষগুলি এ রাজ্যে ‘বিকল্প চাষ’ বলেই ধরা হয়। বৃষ্টির অভাবে গত কয়েক বছর আমন ধান চাষে লক্ষ্যপূরণ হচ্ছে না। ‘শস্যগোলা’ বলে পরিচিত পূর্ব বর্ধমানে গত কয়েক বছর ধরে প্রায় ২৫%, মুর্শিদাবাদে ৪৫-৬৭%, বীরভূম ও পুরুলিয়ায় ৩০-৩৫%, বাঁকুড়ায় ৩০% পর্যন্ত বৃষ্টির ঘাটতি হয়েছে। চলতি বছরে উত্তরবঙ্গের মালদহ থেকে উত্তর দিনাজপুর পর্যন্ত ২৯-৫৯% পর্যন্ত বৃষ্টির ঘাটতি রয়েছে। সুবিমলের দাবি, “ধান চাষে কী ভাবে ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার কম করা সম্ভব, তা নিয়েও গবেষণার পরিকল্পনা রয়েছে।” তিনি জানান, ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার কমানোর সঙ্গে, চাষিদেরআর্থিক লাভ কতটা হচ্ছে, তা দেখার পরে সরকারের কাছে প্রয়োগের কথা জানানো হবে।
রাজ্যের কৃষি উপদেষ্টা তথা পঞ্চায়েতমন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার বলেন, “ওই গবেষণা আমাদের কাছে এলে, তা বিশদে দেখব। আমাদের রাজ্যে প্রযোজ্য হলে, অবশ্যই তা প্রয়োগ করা হবে।” তবে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ডিন সঞ্জয় দত্তরায় মনে করছেন, “এই গবেষণা বড় চাষিদের সুবিধা দেবে। কিন্তু প্রান্তিক চাষিরা কতটা সুবিধা নিতে পারবেন, সংশয় আছে।” যদিও সুবিমল দাবি করেন, যে সব ছোট চাষির পক্ষে মাটি পরীক্ষার যন্ত্র কেনা সম্ভব নয়, তাঁদের কথা ভেবেই এই ‘মডেল’ তৈরি করা হয়েছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)