Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

কবিতার ভাষার মতো ঋজু তাঁর মেরুদণ্ডও

প্রথম দিকে গল্প ও উপন্যাস লেখাতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন দেবদাস আচার্য। পরে কবি অরুণ বসুর অনুপ্রেরণায় তাঁর কবিতা লেখা শুরু হল। প্রকাশিত হতে থাকল একের পর এক কাব্যগ্রন্থ। সাহিত্যিকের কথা বললেন সুস্মিত হালদার।প্রথম দিকে গল্প ও উপন্যাস লেখাতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন দেবদাস আচার্য। পরে কবি অরুণ বসুর অনুপ্রেরণায় তাঁর কবিতা লেখা শুরু হল। প্রকাশিত হতে থাকল একের পর এক কাব্যগ্রন্থ। সাহিত্যিকের কথা বললেন সুস্মিত হালদার।

ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:৫৩
Share: Save:

মোষের পিঠে চড়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল এক রাখাল বালক। সকলেই যেন একটু হকচকিয়ে গেলেন। সম্মেলন শুরু হতে চলেছে। তার আগে এই দৃশ্য। হবেই বা না কেন? এই সম্মেলনের অন্যতম আয়োজক যে কবি দেবদাস আচার্য। এই রাখাল বালকই যে ‘শতজলঝর্নার ধ্বনি’ সম্মেলনের ফিতে কেটে উদ্বোধন করবে। কারণ, কবি দেবদাস আচার্য যে চেয়েছেন সাহিত্যকে ‘এলিট’ ছোঁয়া থেকে মুক্ত করে প্রান্তিক মানুষের মাঝখানে দাঁড় করাতে।

তিনি ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধী’। তিনি ষাটের দশকের ‘হাংরি জেনারেশন’এর প্রতিনিধি। তাঁর কাব্যে তাঁর জীবন চর্চায় বার বার ফুটে উঠেছে সেই রূপ। যার ভূমি তৈরি করেছিল ছোট্টবেলা থেকে। উদ্বাস্তু পরিবারের চরম অভাব আর লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে।

ছাত্রজীবনে যাঁর মনে গভীর ভাবে প্রভাব ফেলে ছিল বামপন্থা। যা তিনি আজীবন স্বযত্নে লালন করে গিয়েছেন। যদিও কোনও দিনই তাঁকে কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হতে দেখেননি কেউ। কিন্তু তাঁর গদ্যে, তাঁর কবিতায় ফুটে উঠেছে বার বার। তাই তো ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদে অনশনে বসে যেতে একবারের জন্য ভাবেননি তিনি। ১৯৬৭ সালে ১৩ জানুয়ারি আমেরিকাবাসীদের একটা অংশ এই যুদ্ধের প্রতিবাদে মুখর হচ্ছেন। তখন আমেরিকার একদল কবি সমগ্র বিশ্বের সমস্ত দেশের কবিকে এক দিনের জন্য প্রতীকী অনশনের ডাক দেন। সেই ডাকে সারা দিয়ে ১৩ জানুয়ারির রাতে মূলত তাঁরই উদ্যোগে টাউন হলের বারান্দায় অনশনে বসে যান বেশ কয়েকজন কবি। পরদিন সকালে সেই অনশন কর্মসূচিতে ভিড় বাড়তে থাকে।

১৯৮৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টোবর দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের মধ্যে লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে সম্পর্কিত সম্পাদক ও লেখকদের নিয়ে কৃষ্ণনগরে আয়োজন করা হয়েছিল সম্মেলন। উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্য সাহিত্যের বিকল্পে সৃজনশীল মুক্তমনের সাহিত্য ধারাকে লিটম ম্যাগাজিনগুলির মাধ্যমে এগিয়ে

নিয়ে যাওয়া।

অন্য জায়গায় চেষ্টা করেও সম্ভব না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত দেবদাস আচার্যকে দায়িত্ব দেওয়া হল। তিনি নিয়েও নিলেন সেই দায়িত্ব। এগিয়ে এলেন কৃষ্ণনগরের আরও কয়েকজন কবি। সেই সম্মেলনের ফিতে কাটানো হল রাখাল বালককে দিয়ে।

এটা তিনিই পারেন। কারণ তিনি যে দেবদাস আচার্য। জীবনের মতোই তাঁর কাব্যে, তাঁর গদ্যে প্রতিটা বাঁকে ছাপ রেখে দিয়েছেন এক ব্যতিক্রমী সৃষ্টিসুখের উল্লাস।

অধুনা কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা ব্যতিক্রমী এই অন্তরমুখী মানুষটার জন্ম ১৯৪২ সালের ৩ জুলাই। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার বন্ডবিল গ্রামে। পাঁচ ভাই দুই বোন। দেবদাসবাবুই বড় সন্তান। বাবা দয়াময় আচার্য ছিলেন ছোট ব্যবসায়ী। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ওরার বাংলার হাজার হাজার পরিবারের মতো তাঁদের পরিবারে নেমে এল ভয়ঙ্কর বিপর্যয়। ১৯৪৮ সালের এক সন্ধ্যায় তিনটে গরুর গাড়িতে করে অজানার উদ্দ্যেশে সব ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ল আচার্য পরিবার। সঙ্গে মাত্র আড়াশো টাকা আর বিছানার ভিতরে লুকিয়ে রাখা কিছু গহনা। দুই সন্তানকে নিয়ে আলমডাঙা স্টেশন থেকে দয়াময় ও আশালতা চেপে বসলেন ট্রেনে।

জানলা দিয়ে কোনও মতে কামরার ভিতরে যেন ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হল সেই ছোট্ট শিশুটিকে। অনেক কষ্টে বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছাতে পারল সেই শিশু। পরদিন ট্রেন এসে পৌঁছাল দর্শণা স্টেশনে। চলল ‘চেকিং’। ভাগ্যক্রমে তাদের তল্লাশি চালানোর আগেই ছেড়ে দিল ট্রেন। ফলে সেই টাকা আর গহনা হাত ছাড়া হল না। তাঁরা একসময় এসে পৌঁছালেন রানাঘাট স্টেশনে। কোনও রকমে ট্রেন থেকে নামতে পারলেন তাঁরা। প্লাটফর্মে তাদের বসিয়ে যেন উধাও হয়ে গেল বাবা আর মামা। বেশ কিছু সময় ফিরে এলেন। সেখান থেকে বীরনগর। উঠলেন একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে। ভাড়ায়। শুরু হল কঠিন জীবন সংগ্রাম। দয়াময়বাবু শান্তিপুর থেকে তাঁতের কাপড় নিয়ে যেতেন হাওড়ার হাটে। তাতে মিলত সামান্য কমিশন।

দারিদ্র আর বেঁচে থাকার লড়াই। সেই লড়াই চালাতে চালাতে ১৯৫১ সালে আচার্য পরিবার আবার যেন শ্যাওলার মতো ভাসতে ভাসতে এসে উঠল কৃষ্ণনগরে। একটা ভাড়া বাড়িতে। এবার দয়াময়বাবু একটা কাপড়ের দোকানের সামনে খুলে বসলেন সেলাই মেশিন নিয়ে। সেখান থেকে ১৯৫৩ সালে রাধানগরে সাড়ে তিন কাঠা জমি কিনে টিনের আর টালির চালের ঘর বানিয়ে বসবাস শুরু হল।

স্কুলের পাঠ শুরু হল অনেক দেরিতে। ভেসে থাকা জীবনে তাঁর স্কুলে যাওয়া হয়নি। দশ বছর বয়সে প্রথম স্কুলে পা। এভি স্কুলে সরাসরি ভর্তি হলেন পঞ্চম শ্রেণিতে। সেখান থেকে কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজ। বাংলা অনার্স নিয়ে পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। কিন্তু পড়া শেষ হল না। তার আগেই তিনি চাকরি পেয়ে গেলেন কৃষি দফতরে। পড়া হল না আর।

সাহিত্য তাঁর রক্তে। কবিতা তাঁর জীবন জুড়ে। যার ভিত তৈরি হয়েছিল সেই স্কুল জীবনেই। তবে প্রথম দিকে তিনি পদ্যের পাশাপাশি গদ্য লিখতেন। স্কুলের পত্রিকায় কবিতা বার হল। সেই সঙ্গে তাঁকে পত্রিকা সম্পাদকেরও দায়িত্ব দেওয়া হল। এরই মধ্যে একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে চুপিচুপি স্থানীয় ‘বঙ্গরত্ন’ কাগজে পাঠিয়ে দিলেন গল্প। সেই গল্প দুই কিস্তিতে ছাপা হল সেই কাগজে। সেই সময় থেকেই শুরু হল বৃন্দাবন গোস্বামীর সাহিত্য আড্ডায়। সেখানেই তিনি নিজেকে তৈরি করতে থাকলেন একটু একটু করে।

প্রথম দিকে তিনি গল্প ও উপন্যাস লেখাতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। পরে কবি অরুণ বসুর অনুপ্রেরণায় তাঁর কবিতা লেখা শুরু হল। প্রকাশিত হতে থাকল একের পর এক কাব্যগ্রন্থ।

ষাটের দশক। সমাজ ও জীবন ছিল প্রতিবাদ, প্রতিরোধের সময়। তাঁর প্রভাব পড়ল সমাজ জীবনে, রাজনীতিতে। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে ডান-বাম দলগুলি। সমাজ ও রাজনীতিতে তখন এক অস্থির দিশাহীন অবস্থা। তার সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন কবি। তার সরাসরি প্রভাব পড়তে থাকল তাঁর কাব্যচর্চায়। তাঁর নানান কর্মকাণ্ডে।

সেই ভাঙনের মধ্যে দাঁড়িয়ে কবি নিজেও ভাঙতে থাকলেন। আর সেই ভাঙনের মধ্যে থেকে এক নতুন দিশার সন্ধান করতে থাকলেন কবি। তাঁর চিন্তা চেতনায়, তাঁর কাব্যের ভাষায় এক নতুন ধারার প্রবর্তনের চেষ্টা করে যেতে থাকলেন। দরবারি ঘরানা থেকে কবিতাকে বার করে এনে মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলেন। তৈরির চেষ্টা করলেন জনমুখি ঘরানা তৈরির। তাঁর ‘কালক্রম ও প্রতিধ্বনি’ , ‘মৃৎশকট’, ‘মানুষের মূর্তি’, ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ ও ‘আচার্যর ভদ্রাসন’ কাব্যগ্রন্থগুলিতে স্বগৌরবে তা মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা পেল। এর মধ্যে শ্রমজীবী জনজীবন ও সমাজ, মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত সংগ্রামী জনজীবন যেন প্রাণ পেল তাঁর কাব্যে। যেন, ‘হুড়মুড় করে ঢুকে গেল।’

এ ভাবেই চলছিল সব। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁর মধ্যে একটা নতুন জীবনবোধ তৈরি হল। এতকাল যা ছিল বহির্মুখী তা ক্রমশ অঅন্তর্মুখী হয়ে উঠল। তাঁর ‘তর্পণ’ কাব্যগ্রন্থটির সময় থেকে ‘তিলক মাটি’তে গিয়ে এক নতুন ভাষা, এক নতুন আঙ্গিকের রূপ নিল।

কবিতার শরীর থেকে বহিরঙ্গের যে জাঁকজমক তা ঝরিয়ে অন্তরঙ্গের ভাষায় তিনি স্বচ্ছন্দ হলেন। সেই ভাষাই শব্দের আড়ম্বর সরিয়ে বিশুদ্ধ বোধ প্রকাশের জন্য যে সীমিত ও নির্ভার শব্দগুলি দরকার সেই শব্দে সেই ভাষায় তিনি কাব্য রচনা করতে শুরু করলেন। যা এখনও বহমান।

এই পর্যন্ত তাঁর ২৩টি কাব্যগ্রন্থ ও চারটি গদ্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁকে দেওয়া হয়েছে পঞ্চাশেরও বেশি সম্মাননা ও পুরস্কার। ২০১২ সালে তাঁকে দেওয়া হয় ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডমি’ পুরস্কার। কিন্তু কোনও কিছুই তাঁকে ‘পুরস্কার লোভী’দের দলে টেনে আনতে পারেনি। কবিতার ভাষার মতোই তাঁর মেরুদণ্ড ঋজু। তাই তো ৭৬ বছরের তরতাজা যুবক অনায়াসে উচ্চারণ করতে পারেন, “জীবন যে অনেক বড়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Devdas Acharya দেবদাস আচার্য
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE