Advertisement
০৪ মে ২০২৪
Education

হকারি থেকে হাতে পেনসিল ফেরালেন শিক্ষকেরাই

শিক্ষিকার পোড়খাওয়া চোখ জানতে চেয়েছিল, স্কুলে যাওনি কেন? সে কথা জানতে চাওয়ায় বছর দশেকের দুই বালক শিক্ষিকাকে জানিয়েছিল তাদের বাড়ির হতদরিদ্র অবস্থার কথা।

বাবা এবং দুই শিক্ষক-শিক্ষিকার সঙ্গে দুই ভাই।

বাবা এবং দুই শিক্ষক-শিক্ষিকার সঙ্গে দুই ভাই। —নিজস্ব চিত্র।

দিলীপ নস্কর
মগরাহাট শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০২৩ ০৭:৪৯
Share: Save:

যে হাতে পেনসিল ধরার কথা, সেই হাতে ছিল প্লাস্টিকে মোড়া ঠান্ডা পানীয়। হকারি করছিল দুই ভাই। ডায়মন্ড হারবার-শিয়ালদহ শাখার একটি লোকাল ট্রেনের কামরায় তাদের সঙ্গে হঠাৎ দেখা এক স্কুল শিক্ষিকার। তার পরেই জীবনটা বদলে গেল মগরাহাটের দুই বালকের।

মা ‘হারিয়ে গিয়েছেন’ দু’বছর আগে। বাবা কাজ করতেন ইটভাটায়। সেখান থেকে দুই সন্তানকে নিয়ে চলে আসেন মগরাহাটে। কঠিন অসুখে আক্রান্ত সেই বাবার দেখভালের জন্যই স্কুল ছেড়ে হকারি শুরু করে সোম সর্দার ও তার ভাই শুভ। আর সেই ঠান্ডা পানীয় বেচতে গিয়েই দেখা উস্তির মড়াপাই লোরেটো গার্লস হাই স্কুলের শিক্ষিকা নীপা বসুর সঙ্গে, ডায়মন্ড হারবার লাইনে ধামুয়া স্টেশনে।

শিক্ষিকার পোড়খাওয়া চোখ জানতে চেয়েছিল, স্কুলে যাওনি কেন? সে কথা জানতে চাওয়ায় বছর দশেকের দুই বালক শিক্ষিকাকে জানিয়েছিল তাদের বাড়ির হতদরিদ্র অবস্থার কথা। জনিয়েছিল, বাবার চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতেই ‘হকারি’ করতে বাধ্য হচ্ছে তারা। পড়াশোনা করতে চায় কি না, জানতে চাওয়ায় প্রথমে কিছু ক্ষণ চুপ। তার পরে তারা পাল্টা প্রশ্ন করে, স্কুলে গেলে বাবার কী হবে? তখনই দুই ভাইয়ের থেকে তাদের বাবার মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করেন নীপা। তাঁকে দুই ভাই জানিয়েছিল, তারা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে।

স্কুলে এসে নীপা সরাসরি ফোন করেন তাদের বাবাকে। শিক্ষিকার কথায়, ‘‘আমি দুই নাবালককে স্কুলে ভর্তি করানোর কথা জানাই ওদের বাবাকে। উনি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। অনেক বোঝানোর পরে তাঁকে রাজি করানো গিয়েছে।’’

প্রচেষ্টা সফল। সম্প্রতি উস্তির সরাচি অম্বিকাচরণ স্কুলের শিক্ষক সঞ্জয় দাসের চেষ্টায় সোম ও শুভকে মন্দিরবাজারের বিদ্যাধরপুর নবকুমার বিদ্যামন্দির হাই স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। এ দিন স্কুলে এসেছিলেন তাদের বাবা। ছেলেদের স্কুলের আঙিনায় ফিরতে দেখে কেঁদে ফেলেন তিনি। বলেন, ‘‘আমি আর ক’দিন বাঁচব! নানা রোগে জর্জরিত। স্কুলে না ফিরলে হয়তো ছেলে দু’টো অন্ধকার জগতে চলে যাবে। ওই শিক্ষিকার কাছে আমি চির ঋণী।’’

নীপা ও সঞ্জয় দুই ভাইকে পোশাক কিনে দিয়েছেন।বিদ্যাধরপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক দীপঙ্কর মিস্ত্রি বলেন, ‘‘স্কুলছুটদের শিক্ষার জগতে ফেরানো আমাদের কর্তব্য। ওদের কাছে শুধু পঞ্চায়েতের দেওয়া জন্মের শংসাপত্র ছিল। ছেলে দু’টির বয়স দশ বছর। তাই ওদের পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়েছি। স্কুলের হস্টেলেই থাকবে সোম ও শুভ। বিষয়টি স্কুল পরিদর্শককে জানিয়েছি।’’

দুই নাবালকের বাবা জানান, এক সময়ে তিনি নদিয়ার নবদ্বীপে ও পূর্ব বর্ধমান জেলায় একাধিক ইটভাটায় কাজ করেছেন। এক সহকর্মীকে বিয়ে করেছিলেন। বছর দুই আগে নিখোঁজ হয়ে যান তাঁর স্ত্রী। তার পরে ছেলেদের নিয়ে ফিরে আসেন মগরাহাটে। সেখানে থাকেন চট ঘেরা পলিথিন ছাউনির কুঁড়ে ঘরে। তিনি বলেন, ‘‘চলাফেরার ক্ষমতা কার্যত নেই। আগে ট্রেনে পেয়ারা বিক্রি করতাম। শয্যা নেওয়ার পরে ছেলেরাই সংসারের হাল ধরে।’’ নীপা বলেন, ‘‘শিক্ষা দফতরের অনুমতি নিয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাদের ভর্তি করিয়েছেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Education Teacher Boys
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE