Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে স্কুল, ছাত্রের অভাবে বিএড কলেজ

যেন শাঁখের করাতের মুখে পড়েছে রাজ্যের স্কুলশিক্ষা! প্রায় চার বছর কোনও নিয়োগ নেই। রাজ্যের বহু স্কুলেই শিক্ষক বাড়ন্ত। আর শিক্ষকতার পাঠ মেলে যেখানে, সেই বিএড কলেজগুলি ধুঁকছে ছাত্রাভাবে। কোথাও পড়ুয়ার সংখ্যা ১০, কোথাও ৩০!

নুরুল আবসার ও সুপ্রিয় তরফদার
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৬ ০৯:৫২
Share: Save:

যেন শাঁখের করাতের মুখে পড়েছে রাজ্যের স্কুলশিক্ষা!

প্রায় চার বছর কোনও নিয়োগ নেই। রাজ্যের বহু স্কুলেই শিক্ষক বাড়ন্ত। আর শিক্ষকতার পাঠ মেলে যেখানে, সেই বিএড কলেজগুলি ধুঁকছে ছাত্রাভাবে। কোথাও পড়ুয়ার সংখ্যা ১০, কোথাও ৩০!

সমস্যা কবে মিটবে, তা নিয়ে দিশা দেখাতে পারেননি রাজ্যের শিক্ষাকর্তারা। তাঁদের অনেকে মেনে নিয়েছেন শিক্ষক নিয়োগ আটকে থাকায় বিএড কোর্সের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন হবু শিক্ষকেরা। কেউ কেউ অবশ্য বেসরকারি কলেজে বিএড পড়ার খরচ বৃদ্ধিকেও কারণ

হিসেবে দেখছেন।

শিক্ষক নিয়োগ কেন আটকে রয়েছে সেই প্রশ্নে মুখে কুলুপ শিক্ষা দফতরের কর্তাদের। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য জানিয়েছেন, প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর— সর্বত্রই দ্রুত শিক্ষক নিয়োগ করতে সরকার সচেষ্ট। কিন্তু প্রাথমিকে নিয়োগ নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা হওয়া, মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য নিয়োগে কেন্দ্রের নিয়মাবলিতে পরিবর্তন, বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ-সহ কিছু জটিলতায় প্রক্রিয়াটি আটকে রয়েছে। কেন্দ্র সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছে, যেন দ্রুত তা কাটানো হয়।

স্কুল শিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, গোটা দেশে স্কুল শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের নীতি-নির্ধারক সংস্থা ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর টিচার্স এডুকেশন’ (এনসিটিই)-এর নিয়ম অনুসারে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষকতার জন্য বিএড

ডিগ্রি থাকা বাধ্যতামূলক। তবে, প্রাথমিক বা পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষকতার জন্যে বিএড বাধ্যতামূলক নয়।

সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে রাজ্যে এনসিটিই অনুমোদিত বিএড কলেজের সংখ্যা মোট ৩২৪। তবু, সেই কোর্সে পড়ুয়ার সংখ্যা ক্রমশ তলানিতে ঠেকছে। অথচ বর্তমানে পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষক-শিক্ষিকার শূন্য পদের সংখ্যা ৪০ হাজারেরও বেশি। এ রাজ্যে স্কুল শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা নেয় স্কুল সার্ভিস কমিশন। এই কমিশনের মাধ্যমে ২০১২ সালে পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা হয়েছিল। তার পরে নিয়োগও হয়। সেটাই শেষ। ২০১৫ সালের অগস্টে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা হলেও ফল প্রকাশ হয়নি। কবে তা হবে সে বিষয়টি এখনও অন্ধকারে রয়েছে। চলতি বছর মার্চ মাসে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি ঘিরে জটিলতার সৃষ্টি হয়। ওই পরীক্ষা কবে হবে সেটাও অনিশ্চিত।

বঙ্গীয় শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী সমিতির সাধারণ সম্পাদক (কলকাতা) স্বপন মণ্ডল বলেন, ‘‘সরকার শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিলেও নিয়োগ হচ্ছে না। যে কারণে বিএড ডিগ্রি থেকে পড়ুয়ারা মুখ ফেরাচ্ছেন।’’ রাজ্যের প্রধান শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নীহারেন্দু চৌধুরী বলেন, ‘‘স্কুলগুলিতে শিক্ষকের আকালে পঠনপাঠনও ব্যাহত হচ্ছে। অথচ, শূন্যপদ পূরণ হচ্ছে না। তাই বিএডের প্রতি

ঝোঁকও কমছে।’’

তবে, কলকাতার ছবিটা ততটা হতাশাব্যঞ্জক নয়। কেননা, এখানে বেসরকারি স্কুলের সংখ্যা বেশি। ফলে, বিএড করার পরে ওই সব স্কুলে শিক্ষকের চাকরি পেতে ততটা সমস্যা হয় না। কিন্তু রাজ্যের অন্যত্র সমস্যা মেটার লক্ষণ নেই। আসন ভরাতে এ বার তাদের আওতায় থাকা বেসরকারি বিএড কলেজগুলিতে দ্বিতীয় পর্যায়ে ফের কাউন্সেলিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু, তাতেও আসন কতটা ভরবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

একে তো নিয়োগ বন্ধ, তার উপরে আবার ২০১৪ সাল থেকে বিএড পাঠক্রমের মেয়াদ বেড়ে হয়েছে দু’বছরের। সরকারি স্তরে তার খরচ (২০ হাজার টাকা) তেমন না বাড়লেও বেসরকারি স্তরে বেড়েছে অনেকটাই। প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। এটাও পড়ুয়া-সংখ্যা কমার অন্যতম কারণ বলে মনে করছে শিক্ষা মহল। বস্তুত, সরকারি বিএড কলেজে ভর্তির সুযোগ কম থাকায় ছাত্রছাত্রীরা বেশি ঝোঁকেন বেসরকারি কলেজগুলিতেই। তা ছাড়া, অনেক পডু়য়া আবার অন্য রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে বিএড পড়ছেন। সহজে ডিগ্রিও পেয়ে যাচ্ছেন। ফলে, ফাঁকা থেকে যাচ্ছে এখানকার বিএড কলেজের আসন।

দুবরাজপুরের হেতমপুরের একটি বেসরকারি বিএড কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি সুখেন রানা জানিয়েছেন, সেখানে আসন রয়েছে ১০০টি। গত বার ভর্তি হয়েছিলেন ৬৭ জন। এ বার এখনও কাউন্সেলিং হয়নি। তবে, ভর্তির আবেদনপত্র বিলি হয়েছে মাত্র ১৯টি। তাঁর কথায়, ‘‘এ ভাবে চলতে থাকলে অচিরেই কলেজে তালা পড়বে।’’ চাঁচল বিএড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মহম্মদ আতাউর রহমানও বলেন, ‘‘কলেজের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু ছাত্রছাত্রী বাড়ছে না। আমাদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছে।’’

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় থাকা ৮০টি বেসরকারি বিএড কলেজকে চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে নবগঠিত রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনা হয়েছে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে কলেজগুলিকে জানিয়ে দেওয়া হয়, স্বীকৃতি বজায় রাখতে হলে প্রতি বছর জমা দিতে হবে এক লক্ষ টাকা! এ ভাবে চলতে থাকলে আগামী বছর থেকে বাধ্য হয়ে প্রতিষ্ঠানে বিএড কোর্স বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ওই সব প্রতিষ্ঠানের কিছু কর্তা।

এই অবস্থায় কী বলছেন ছাত্রছাত্রীরা?

দীপোজ্জ্বল মণ্ডল নামে এক চাকরিপ্রার্থী বলেন, ‘‘২০১২ সালের মেধা তালিকায় নাম থেকেও ২২০০ জনের চাকরি হল না। খরচ করে বিএড ডিগ্রি নিয়ে লাভ কী?’’ মালদহের বিএড পড়ুয়া বিক্রম সরকার, প্রসেনজিৎ সিংহদের ক্ষোভ, ‘‘আমাদের পরিবারের ধারণা, কোর্স করেই চাকরি পেয়ে যাব। বাবা-মা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে কোর্স করেও প্রচুর ছেলেমেয়ে বসে রয়েছেন। কারণ নিয়োগ বন্ধ। উৎসাহ তো কমে যাবেই।’’

ফলে, সরকারি বা বেসরকারি— সব ধরনের বিএড কলেজই এখন অস্তিত্ব রক্ষায় চ্যালেঞ্জের সামনে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

college B.ED.
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE