Advertisement
E-Paper

পড়শির টিভিতে নায়ক হওয়ার হাতছানি

গঙ্গার ধারে গ্রাম। ঢেউ ভাঙার শব্দে ঘুম ভাঙতেই মায়ের তাড়ায় ব্যাগ কাঁধে ছুটতাম স্কুলে। হাটকালীগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সেই টালির চাল আর মাটির মেঝেই তখন আমাদের একান্ত আপনজন। বর্ষা কালের অপেক্ষায় বসে থাকতাম। ছাদ চুঁইয়ে জল পড়লেই তো ব্যস! স্কুল ছুটি।

হিরণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৫ ০১:৫৮

গঙ্গার ধারে গ্রাম। ঢেউ ভাঙার শব্দে ঘুম ভাঙতেই মায়ের তাড়ায় ব্যাগ কাঁধে ছুটতাম স্কুলে। হাটকালীগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সেই টালির চাল আর মাটির মেঝেই তখন আমাদের একান্ত আপনজন। বর্ষা কালের অপেক্ষায় বসে থাকতাম। ছাদ চুঁইয়ে জল পড়লেই তো ব্যস! স্কুল ছুটি।

উলুবেড়িয়ার ছোট্ট মফঃস্বলে গঙ্গা, খেলার মাঠ, ইস্কুল ঘর, বাগান, রেললাইন ছিল আমার পাড়া। আর তার সঙ্গে জড়ানো সব মুহূর্তই এখনও আমার পড়শি। দিদিমণিকে বলে স্কুলের পাশেই রাস্তার ধারে লাইন বেঁধে সকলে ‘ছোট বাইরে’-র জন্য যেতাম। তখনই বন্দরে জাহাজ ঢুকত। দেখতে দেখতে ভুলেই যেতাম যে স্কুল আছে। দিদিমণি হাঁক পাড়লে হুঁশ ফিরত। হন্তদন্ত হয়ে সব ছুটতাম।

রোজ সকালে আমার কাজ ছিল শিপ্রা দিদিমণির বাড়ির পুজোর ফুল আর তুলসী পাতার জোগান দেওয়া। দিব্যি নানা জনের বাড়ি থেকে চুরি করে নিয়ে যেতাম। এক দিন উনি জানতে পেরে দিলেন বকুনি! সঙ্গে সঙ্গে বললাম, “আপনার জন্যই তো আনি, আপনিই বকছেন?” উনি হেসে ফেলে আদর করে বোঝাতে লাগলেন।

আমার আর দিদির তখন সব চেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল মায়ের সঙ্গে মামার বাড়ি যাওয়া। বাসে চেপে ঘাটে পৌঁছতাম। তার পরে নৌকোয় করে ও পারে গিয়ে এক ঘণ্টার হাঁটাপথ উত্তর দুর্গাপুর গ্রাম। ওতেই অ্যাডভেঞ্চার, ওতেই আনন্দ! মামা বাড়ি ছিল স্বর্গের মতো। দাদু-দিদা, মামা-মাইমা, ছোড় দিদুর প্রশ্রয়ে ছিল এক মস্ত স্বাধীনতা। চারিদিকে মাটির বাড়ি, মাটির গন্ধে ঘেরা গ্রাম। দাদুর ধানি জমি ছিল। আল ধরে হেঁটে চলতাম। গাছ থেকে মটরশুঁটি পাড়ছি আর খোলা ছাড়িয়ে খেয়ে চলেছি! মাঠের কোথায় শেষ জানি না। ফেরার সময় পথ ভুলে যেতাম। ওই সমুদ্রের মতো ধান খেত, সন্ধে হলেই চার পাশ নিশ্চুপ। থমথমে সন্ধেয় ছড়ানো মটরশুঁটির খোলা চিনে ঘরে ফিরতাম।

সন্ধেয় আরেকটা মজা ছিল বাবার কাঁধে চেপে গঙ্গার ধারে ধারার দোকানে মিষ্টি খেতে যাওয়া। দোকানের জানলায় বসে এক মনে পান্তুয়া, আলুর চপ খেতাম। আর জোয়ারের সময় দেখতাম নীচ দিয়ে কেমন গঙ্গা বয়ে চলেছে। দিন কয়েক আগে রাস পূর্ণিমা গেল। মনে পড়ে, ছেলেবেলায় ওই সময় বড়দের হাত ধরে মেলা দেখতে যেতাম। মেলায় কেনা ছোট্ট ঢাকটার অবশ্য সারা দিন বেজে সন্ধের আগেই পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হত।

ওই অল্পে খুশি থাকা, যা চাই তা না পাওয়ার যন্ত্রণা শিখিয়েছে এমন কিছু করতে হবে, যাতে সবাই আমাকে এক দিন চেনে। পাড়ায় দত্তদের বাড়িতে তখন টিভি এসেছে। শনিবার একটা করে বাংলা সিনেমা হত, রবিবার হিন্দি সিনেমা আর বুধবার চিত্রহার। ওই দেখার জন্য ওদের বাড়ির জানলার ধারে সবাইকে লাইন দিতে হত। কোনও দিন কারেন্ট চলে গেলে আর আমাদের দুঃখের শেষ থাকত না। সব অপেক্ষা জলে! অঙ্ক পরীক্ষার আগের দিনও মিঠুনদার সিনেমা দেখতাম। দিদির বন্ধুরা মজা করে বলত, চিন্তা নেই, তোরও এক দিন হবে!

বাড়িতে আম, জামরুল, পেয়ারার অনেকগুলো গাছ ছিল। কালবৈশাখির ঝড়ে আম পড়ে আমাদের টালির চাল ভেঙে যেত। পর দিন সকালে ছোট বলেই আমাকে ওপরে উঠিয়ে সেই ভাঙা মেরামত করানো হত। তবে কাজের দায়িত্ব পেয়ে আমার কিন্তু তখন নিজেকে একেবারে নায়ক মনে হত। অপু-দুর্গার মতো আমি, দিদি আর মৌটুসী সাইকেল চালিয়ে চলে যেতাম বাড়ি থেকে একটু দূরে রেল লাইনের কাছে। ওই সিনেমার দেখাদেখি লাইনের ওপরে পাঁচ পয়সার কয়েন রেখে সেটাকে চুম্বক করে বাড়ি ফিরতাম।

পাড়ায় যখন নাটক হত, বেশি মহড়া দিতাম না। কখনও ডোবাইনি বলে কেউ বিশেষ জোরও করত না। এক বার হল কি, স্টেজে উঠে পার্ট ভুলে গিয়েছি। প্রম্পট করছিলেন সুকুমারদা। কিন্তু তাঁর কথাও তখন মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছি না। শেষে আমাকে বোঝানোর জন্য উনি এত জোরে বলতে শুরু করলেন যে দর্শকেরা ব্যাক স্টেজ থেকে ওঁর গলাই শুনতে লাগলেন। আর আমি লিপ মিলিয়ে গেলাম! এখন মনে হয় ডাবিং শেখার বেশ প্রথম পাঠ নেওয়া হয়ে গিয়েছিল সে বার।

কাল্টু, শৌভিক, মলয়, রাজেশ—আমরা বন্ধুরা মিলে সাঁতার শিখেছি পুকুর, খালের পাশাপাশি গঙ্গাতেও। এক ঘণ্টা চান করে যখন উঠতাম, পাঁকের গন্ধ লাইফ বয় সাবানেও যেত না। স্কুল থেকে কোনও দিন সোজা বাড়ি ফিরিনি। মাঠে ফুটবল, কড়ে ব্যাঙ, বুড়ি বসন্ত, লুকোচুরি, কিতকিত কত কী যে খেলেছি! সকালে ঘুম থেকে উঠেও মাঠটাই ছিল আমার এক এবং একমাত্র পাড়া। স্কুলের ঘণ্টা শুনে মনে পড়ত দেরি হয়ে গিয়েছে। ওই অবস্থাতেই কাদা মেখে স্কুলে ছুট। তার পর ক্লাসের ফাঁকে কোনও রকমে থুতু দিয়ে ঘষে ঘষে পায়ের কাদা তোলা। বার বার অসুস্থ হয়েও বৃষ্টির সময় টানা এক মাস ফুটবল খেলা আমাদের বাঁধা ছিল।

উলুবেড়িয়া হাইস্কুলে পড়াকালীন এক বার দিঘায় গিয়েছি এক্সকারশনে। ফেরার সময় প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। অচেনা বিয়ে বাড়িতে ঢুকে খেয়ে দেয়ে পড়ে গিয়েছি বরকর্তার নজরে। ধরা পড়ে বিন্দু আর অনিমেষকে দেখিয়ে আমরা বাকিরা দে ছুট! পর দিন ওরা ফিরে এসে আমাদের এই মারে কি সেই মারে। পরীক্ষার আগেও নিশ্চিন্তে থেকে যেতাম বন্ধুদের বাড়ি। বাড়ির কেউ চিন্তাও করতেন না, আর জেঠিমারাও খাইয়ে পরিয়ে রাখতেন পরম স্নেহে।

শহরের এই ব্যস্ত, বিচ্ছিন্ন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেও পড়শি বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমার ‘নিশ্চিন্দিপুরের’ ওই নদী, মাঠ, মানুষগুলোই। উলুবেড়িয়ার ওই পরিবেশই আজকের আমাকে গড়ে তুলেছে।

uluberia hiron chattopadhay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy