Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

কেল্লার দেশে হিন্দি শিখে ফিরল ছেলে

মামার মুখে কত যে গল্প শুনেছে। মামা তো ওখানেই থাকে আর কোন এক দুর্গের ছায়ায় বসে পুঁতির মালা গাঁথে। যখন ওদের বাড়ি আসে, কত কী যে বলে— রাজারাজড়া, যুদ্ধ, উট, পাথর— হাঁ করে সব গেলে সে।

ফেরা: বহরমপুরের বাড়িতে মায়ের সঙ্গে জয় ভকত। নিজস্ব চিত্র।

ফেরা: বহরমপুরের বাড়িতে মায়ের সঙ্গে জয় ভকত। নিজস্ব চিত্র।

সেবাব্রত মুখোপাধ্যায়
বহরমপুর শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৭ ০৮:৫০
Share: Save:

লটারি বেচতে এক্সপ্রেসে উঠে সেই বহরমপুর থেকে সোজা শিয়ালদহে পৌঁছে গিয়েছিল বছর দশেকের ছেলেটা।

ইতিউতি ঘুরতে-ঘুরতেই শোনে— জয়পুর যাওয়ার ট্রেন ছাড়ছে।

জয়পুর!

দুর্গের দেশ! সোনার কেল্লা!

মামার মুখে কত যে গল্প শুনেছে। মামা তো ওখানেই থাকে আর কোন এক দুর্গের ছায়ায় বসে পুঁতির মালা গাঁথে। যখন ওদের বাড়ি আসে, কত কী যে বলে— রাজারাজড়া, যুদ্ধ, উট, পাথর— হাঁ করে সব গেলে সে।

সেই জয়পুরে যাচ্ছে ট্রেন! ঝোঁকের মাথায় উঠেই পড়ে ছেলেটা। একটু কষ্ট করে রাজস্থান যেতে পারলেই কেল্লা ফতে। চলে যাবে মামার কাছে। আর দেখে কে! এত দিন যা কিছু শুনেছে, সব নিজের চোখে দেখে আসবে।

গত ফেব্রুয়ারিতে সরস্বতী পুজোর ঠিক পর-পর। টানা পাঁচ মাস আর বাড়িই ফিরতে পারেনি জয় ভকত। মামার কাছেও যেতে পারেনি।

জয়ের মনে পড়ে— ‘‘কখনও ট্রেনের মেঝেয়, কখনও বা বাথরুমের পাশে শুয়ে-বসে দু’দিন পরে জয়পুর পৌঁছলাম। তখন মাথায় এল, মামার পুরো নাম তো জানি সঞ্জয় হাজরা। কিন্তু কোথায় থাকে, সেটা তো জানি না। কোথায় খুঁজতে যাব?’’

কেল্লার দেশে এ যেন আর এক হাজরার চক্কর!

সাতপাঁচ ভাবতে-ভাবতে স্টেশন থেকে বেরোতে যাবে, পুলিশ এসে ধরল জয়কে— ‘‘পুলিশকাকুর কাছেই রাতে থাকলাম। ভাল লোক। শুকনো খাবার খেতে দিল।’’

কিন্তু ভারী সমস্যা! বাংলা ছাড়া জয় আর কিছু বোঝে না। ওখানে তার কথা বুঝতেই পারছে না কেউ। ওরাও যে কী বলছে হ্যায়-ম্যায় করে, জয়ও বিন্দুমাত্র বুঝছে না। শেষমেশ ঠাঁই হল এক হোমে, নাম ‘টাওয়ার স্কুল’। আর শুরু হল রোজ সকাল-বিকেল নিয়ম করে হিন্দি আর ইংরেজি শেখানো। এক ম্যাডাম শেখাতেন ছবি দেখিয়ে-দেখিয়ে। সোনার কেল্লার বদলে ‘ঘর’, ‘গাঁও’, ‘শহর’, ‘রেলগাড্ডি’, ‘বঙ্গাল’ ঢুকে পড়ল জয়ের মাথায়।

আর মাস চারেক বাদে দশ বছরের বাঙালি ছেলেটা এক দিন গোটা গোটা করে বলতে পারল— ‘ম্যায় পশ্চিম বঙ্গাল কা মুর্শিদাবাদ মে রহতা হুঁ। শহর হ্যায় বহরমপুর। ম্যায় ঘর যানা চাহতা হুঁ।’’ শুরু হয় তৎপরতা। রাজস্থান পুলিশ বহরমপুরে সরকারি হোমে পৌঁছে দিয়ে যায় জয়কে। ঘরের ছেলে ঘরে ফেরে।

মঙ্গলবার বহরমপুরের ঘিঞ্জি কান্দি বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া ছিটেবেড়ার ঘরের দাওয়ায় শতরঞ্চিতে ছেলেকে নিয়ে বসে জয়ের মা মায়া ভকত বলেন, ‘‘ওর বাবা বিশ্বজিৎ টোটো চালান। আর আমি লটারির টিকিট বিক্রি করি। আমার শরীর খুব খারাপ থাকায় সে দিন ছেলে বেরিয়েছিল টিকিট নিয়ে। তার পরে এই কাণ্ড!’’

অভিযান শেষ।

আবার অম্বেডকর প্রাথমিক স্কুলে ক্লাস ফোরে যেতে হবে জয়কে। ফের সেই বাংলা বইখাতা, অঙ্কের ক্লাস। মায়ের আঁচল আঁকড়ে একগাল হাসে ছেলে— ‘‘ওখানে এমনিতে খুব ভাল ছিলাম, জানেন! খালি মায়ের জন্য বড্ড মনকেমন করত।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rajasthan Joy bhakat রাজস্থান
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE