E-Paper

পুজোয় দেখা হবে, জেগে থাকে প্রতীক্ষা

আপনার আসল নাম কোনটা? ঝর্নার মতো কলকলিয়ে হেসে উঠলেন মধ্য ত্রিশের যুবতী। রিনরিনে গলায় জবাব এল, ‘‘কেন চন্দনা।’’ আর শোভা? ‘‘ওটা বনপার্টির নাম। মামলার কাগজে আছে।’’— স্বর এ বার দৃঢ়।

দেবাঞ্জনা ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:৫২
এমনই দুই পাখি...। দুই পোষ্যকে নিয়ে চন্দনা। বেলপাহাড়ির মাজুগোড়ায়।

এমনই দুই পাখি...। দুই পোষ্যকে নিয়ে চন্দনা। বেলপাহাড়ির মাজুগোড়ায়। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

মিঠু, মিঠু, মিঠু—

ঝন্টুর মুখে দিনরাত এক বুলি। অন্য শব্দ শেখানোর জো নেই। শরৎ মেঘের খোলা আকাশ ফেলে সে উড়েও বেড়ায় মিঠুর গায়ে গায়ে। ডানা ঝাপটায়, চেয়ে থাকে অপলক।

এই টিয়া জোড়া চন্দনার বড় সাধের। পুষেছেন, নাম রেখেছেন, তবে খাঁচায় বাঁধেননি। বন্দি জীবনের জ্বালা যে এক জীবনেই বুঝেছেন তিনি।

চন্দনা সিং ওরফে শোভা মান্ডি। প্রাক্তন মাওবাদী নেত্রী। ঠিকানা—গ্রাম: মাজুগোড়া, বেলপাহাড়ি, জেলা: ঝাড়গ্রাম। পাক্কা ১৫ বছর জেল খেটে বেরিয়েছেন গেল জুলাইয়ে।

আপনার আসল নাম কোনটা? ঝর্নার মতো কলকলিয়ে হেসে উঠলেন মধ্য ত্রিশের যুবতী। রিনরিনে গলায় জবাব এল, ‘‘কেন চন্দনা।’’ আর শোভা? ‘‘ওটা বনপার্টির নাম। মামলার কাগজে আছে।’’— স্বর এ বার দৃঢ়।

ছটফটে কিশোরী বেলাতেই আলগা একটা দৃঢ়তা চন্দনার ছিল। অন্যায় দেখলে গলা তুলতেন, পাঁচ জনের ভালর কথা ভাবতেন। দুর্গামূর্তিও ভারী প্রিয় ছিল ওই কারণেই। আদিবাসী গ্রাম থেকে মিনিট পনেরোর পথ ভুলাভেদার মণ্ডপ। মায়ের তেজ আর হাতে অস্ত্র চোখ টানত কচি মেয়েটার। মনে হত, সকলের ভালর জন্যই তো মায়েরদশ প্রহরণ।

চন্দনাও সব্বার ভাল চেয়েই ঘর ছেড়েছিলেন মাত্র ১২ বচ্ছরে। গাঁয়ের স্কুলে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে পড়াশোনায় দাঁড়ি। চোখে তখন নতুন সমাজ, নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন। ‘‘অতশত বুঝতাম না। তবু মনে হয়েছিল, ওই পথে সকলের দুঃখ ঘুচবে, গরিবের বাঁচা সহজ হবে। তবে এত ভাল হবে টের পাইনি!’’ — বাঁকা হাসিতে আবার ঝর্নার কলরব। কাছেই ময়ূর ডাকছে।

এ বার পুজো বেশ আগে। বর্ষার গন্ধ গায়ে মেখেই উঁকি দিচ্ছে শালুক, শিউলি, কাশ। পুজোয় ঘোরার প্ল্যান সারা চন্দনারও। দাদা তারক আর বৌদি ছবির সংসার এখন তাঁর ঠিকানা। ভাইপো-ভাইঝিরা সঙ্গী। সদ্য কিশোরীর উচ্ছলতায় চন্দনা বললেন, ‘‘কলকাতায় যাব গো। এত দিন বাদে পুজো, সব উসুল করে নিতে হবে।’’ মায়ের মুখ দেখেছেন জেলখানার পুজোতেও। মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বহরমপুর জেল— সব প্রতিমা কেমন যেন করুণ। মা তো!

চন্দনার নিজের মা লক্ষ্মী সিং অসুস্থ। বয়সের ভারে নয়, মনোরোগে। চন্দনা ফেরার পরে আরও সিঁটিয়ে থাকেন। সর্বক্ষণ মেয়েকে বলে চলেছেন, ‘‘বাইরে যাস না, ফোনে কথা বলিস না, কারও ডাকে সাড়া দিস না।’’ অভাবের সংসার। তারক আর ছবির দিনমজুরির ভরসায় এতগুলো পেট চলছে। আত্মসমর্পণ করেননি। ফলে, চন্দনা সরকারের মাওবাদী পুনর্বাসন প্যাকেজ পাবেন কি না অনিশ্চিত। তবে মায়ের চিকিৎসা হচ্ছে। চন্দনা জানালেন, ‘‘ওষুধ চলছে। আসলে আমার চলে যাওয়া, ধরা পড়া, জেল খাটা— সব মায়ের মনে দাগ কেটেছে। আর কাছছাড়া করতে চায় না।’’

চন্দনাও আর অতীত মনে করতে চান না। উল্টে মানেন, ‘‘ভুলই হয়েছিল।’’ ২০০৯ সালে ঝাড়খণ্ডের ঘাটশিলায় ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে পুলিশকর্মীর মৃত্যু মামলায় তাঁর নাম জড়ায়। সেখানকার পুলিশের হাতেই ধরা পড়েন ২০১০-এ। ২০১৪-য় ঘাটশিলা আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেয়। ঝাড়গ্রামে অন্য মামলাও ছিল। একে একে সব ক’টায় জামিন মেলে আর ঝাড়খণ্ডের মামলায় বেকসুর হন। অবশেষে জেল-মুক্তি।

তবে এই খোলা হাওয়ার পালে যে মানুষটার সঙ্গে চন্দনা ভাসতে চান, সে এখনও গারদের ওপারে। রাজেশ মুন্ডা, চন্দনার স্বামী। শিলদা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত রাজেশ এখন বহরমপুর জেলে। তার বাড়ি ঝাড়খণ্ডে। আত্মীয়কুটুমের বৃত্তেই আলাপ দু’জনের। তারপরে ভালবাসাবাসি। মাওবাদী স্কোয়াডেও এক সঙ্গেই গিয়েছিলেন। বিয়ে হয় তারও পরে।

দুইয়ে মিলে পুজোর প্রেমও ঝাড়খণ্ডেই। ‘‘রাঁচী, টাটানগর সব ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখেছি। এক প্লেটে চাউমিন, কাচের চুড়ি, মেলা’’— চন্দনার চোখে ঝিলিক। এ বার পুজোর আগে একটি বার বহরমপুর জেলে যেতে চান। একটাই সাধ, ‘‘দেখাটুকু হবে, আর দু’টো কথা।’’

শুধু কথা নয়, ঝন্টুকে এক কলি গানও ঠিক শেখাবেন চন্দনা। ‘‘সেই মোচড় দেওয়া লাইনখান গো’’— মিলন হবে কত দিনে...।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Maoist Leader Durga Puja 2025 Jhargram

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy