সেই ১৯৭০-এর দশকে নকশাল আন্দোলনের উত্তাল সময়ে বাংলা জুড়ে স্লোগান উঠেছিল, ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরো’। পরবর্তী কালে বামপন্থী ফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এলে তার ভোট-অঙ্কের মূল সুর হয়ে ওঠে ওই ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা’র নীল নকশা। বেশ কয়েক দশক পেরিয়ে বঙ্গ রাজনীতিতে আবারও কি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে ‘গ্রাম দিয়ে ব্যালট ঘেরা’র পরিকল্পনা? বঙ্গ আরএসএসের অন্দরে কান পাতলে তেমন আভাসই পাওয়া যাচ্ছে।
সঙ্ঘ সূত্রের খবর, আগামী বছর জানুয়ারি মাস থেকে ‘হিন্দু সম্মেলন’ করতে চলেছে তারা। সাদা চোখে দেখলে শতবর্ষ উপলক্ষে সঙ্ঘের কাজকর্মকে আরও তীব্র করতে গ্রাম পঞ্চায়েত ও ওয়ার্ড-ভিত্তিক কর্মসূচি নেওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে। কিন্তু এর নেপথ্যেই রয়েছে রাজনীতির অঙ্ক। গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে প্রায় এক লক্ষ ‘হিন্দু সম্মেলন’-এর আয়োজন করতে চলেছে সঙ্ঘ।
লক্ষ্য, এক একটি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রতিটি হিন্দু পরিবারের অন্তত এক জনকে সেই সম্মেলনে শামিল করা। শহরে যেখানে পুর-নিগম রয়েছে, সেখানে ওয়ার্ড কিংবা বরো-ভিত্তিক, ছোট শহরে পুরসভা-ভিত্তিক এই সম্মেলনের আয়োজন করা হবে। পুজোর পর থেকেই শুরু হবে প্রস্তুতি। সঙ্ঘের স্পষ্ট দাবি, ‘হিন্দু রাষ্ট্রের’ ভাবনা মাথায় রেখে হিন্দুদের এককাট্টা করার লক্ষ্যেই এই কর্মসূচি।
রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের ব্যাখ্যা, পুজোর পর থেকেই রাজ্যের আবহ অনেকটা নির্বাচনমুখী হয়ে যাবে। সেই পরিস্থিতিতে একেবারে নিচু স্তর থেকে তীব্র হিন্দুত্বের প্রচার শুরু হলে তার প্রভাব নির্বাচনে পড়বে। পাশাপাশি একটি অংশের মতে, পশ্চিমবঙ্গে গ্রামের ভোটে ভাগ বসাতে না পারলে কোনও দলের পক্ষেই ক্ষমতায় আসা সম্ভব নয়। শেষ দফার বামফ্রন্ট সরকারের আমলে গ্রামাঞ্চলের জনসমর্থনে ধস নেমেই তাদের পতন ত্বরান্বিত হয়েছিল। এখন আবার তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারের শক্ত জমি এই গ্রামের ভোটের উপরে ভর করেই। তাই গ্রামের ভোটে নজর রেখে এই পরিকল্পনা সাজাচ্ছে সঙ্ঘ পরিবার।
এমনিতেই বাংলায় বিজেপির এখনও পর্যন্ত জেতা আসন মূলত গ্রাম-কেন্দ্রিক। তবে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় আসন না জিতলেও গত লোকসভা নির্বাচনে পুর-এলাকায় তাদের ফলাফল ভাল হয়েছিল। এ বার গেরুয়া শিবিরের লক্ষ্য বাড়তি ৪-৫% ভোট। সেই বাড়তি ভোট আনতেই সঙ্ঘ পরিকল্পনা সাজাচ্ছে বলে মত রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের।
সঙ্ঘের দক্ষিণবঙ্গ প্রান্ত প্রচার প্রমুখ বিপ্লব রায় অবশ্য বলেন, “সঙ্ঘ শতবর্ষ উপলক্ষে বেশ কিছু কর্মসূচি নিচ্ছে। বিজয়া দশমীর দিন থাকবে গণবেশ পরে রুট-মার্চ, শারীরিক কসরত, বিভিন্ন খেলা। তার পরে বিশিষ্ট জনদের সঙ্গে মতবিনিময়, আলাপচারিতা এবং শেষে হিন্দু সম্মেলন।” তাঁর সংযোজন, “তবে আমরা কিছু করব না, যা করার গ্রামবাসীরা করবে। আমরা বলে দেব, কোথায় চাষ করতে হবে। ফসল ফলাবেন গ্রামের মানুষ।”
তবে সঙ্ঘেরই একাংশের মত, রাজনৈতিক দল হিসেবে বিজেপির যা সাংগঠনিক শক্তি, তাতে তারা এই মুহূর্তে সব বুথে পৌঁছতে পারবে না। এমতাবস্থায় সঙ্ঘ তার নিজস্ব কর্মসূচির মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি বাড়িতে পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করবে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)