Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Vande Bharat

ট্রেনের শিশা ভাঙল বলে..., বাংলা কি ‘ভাল’ পাওয়ার যোগ্যতা হারাচ্ছে? প্রশ্ন উঠছে বন্দে ভারত-কাণ্ডে

প্রশ্ন উঠেছে, বাংলা কি আদৌ ভাল কোনও কিছু পাওয়ার যোগ্য? কয়েক দিন আগে যে ট্রেনের সূচনা হল এত ধুমধাম করে। এত আড়ম্বর, এত উন্মাদনা নিয়ে, তাকে ‘ভেঙে ফেলা’র চেষ্টা কেন? জবাব খুঁজল আনন্দবাজার অনলাইন।

বাংলায় পর পর দু’দিন পাথর ছোড়া হল চলন্ত বন্দে ভারত এক্সপ্রেস লক্ষ্য করে।

বাংলায় পর পর দু’দিন পাথর ছোড়া হল চলন্ত বন্দে ভারত এক্সপ্রেস লক্ষ্য করে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২৩ ১৯:৪০
Share: Save:

পর পর দু’দিন একই ঘটনা। পাথর ছোড়া হল চলন্ত বন্দে ভারত এক্সপ্রেস লক্ষ্য করে। তাতে ‘সেমি হাইস্পিড’ ওই ট্রেনটির দরজা এবং জানলার কাচ ক্ষতিগ্রস্ত হল। পর পর দু’দিন একই ঘটনার কারণে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক এবং নিরাপত্তাহীনতা ছড়িয়েছে। ‘হামলা’ রুখতে বিশেষ ব্যবস্থা নিচ্ছে রেলপুলিশ। কিন্তু তারই পাশাপাশি প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, এ রাজ্য কি আদৌ ‘ভাল’ কোনও কিছু পাওয়ার যোগ্য?

উত্তরবঙ্গে ছাত্রজীবনের বেশ কয়েক বছর কাটিয়েছেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। বন্দে ভারতে চেপে দিনের দিন খুবই কম সময়ে উত্তরবঙ্গ পৌঁছনো যাবে শুনে এক বার ওই ট্রেন চাপবেন বলে ইচ্ছাপ্রকাশও করেছিলেন। সেই শীর্ষেন্দু বুধবার বললেন, ‘‘পাথর ছোড়ার ঘটনা অবশ্য অন্যান্য রাজ্যেও ঘটে। এটা গোটা উত্তর ভারতেরই একটা সমস্যা। তবে এমন ঘটনা বাংলাতেও যে ঘটছে, সেটা খুবই লজ্জার ব্যাপার এবং একই সঙ্গে বিপজ্জনকও। এই উৎপাত বন্ধ করতে কী করা উচিত, আমার জানা নেই। কারণ, গোটা রেললাইন জুড়ে তো পাহারা বসানো সম্ভব নয়! প্রচার চালিয়ে যদি শুভবুদ্ধির উদয় ঘটানো যায়, সেই চেষ্টাই করতে হবে মনে হয়।’’ লেখকের মতে, ‘‘এর ফলে বাঙালি তথা বাংলার ভাবমূর্তি যে সারা দেশের কাছে খারাপ হচ্ছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিছু মানুষের অসভ্যতার জন্য আমরা নিজেদের সভ্য বলে দাবি করতে পারছি না, এটা খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয়। এ যুগেও যে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, তা ভেবেই বিস্মিত হচ্ছি। একই সঙ্গে খুব রাগও হচ্ছে।’’

ভারতীয় মহাকাব্য ও পুরাণ বিশেষজ্ঞ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি অবশ্য এর মধ্যে ‘রাজনীতি’ দেখছেন। তবে যারা পাথর ছুড়ছে, তাদের নিজস্ব কোনও রাজনীতি নেই বলেই মনে করেন তিনি। তাঁর মতে, রাজনীতির কারবারিদের দুটো ভাগ আছে। এক দল পরিশোধিত রাজনীতি করে। অন্য দল অপরিশোধিত। ট্রেনে পাথর ছোড়াটা এই অপরিশোধিত রাজনীতিরই অঙ্গ। নৃসিংহপ্রসাদের কথায়, ‘‘পরিশোধিত রাজনীতি যাঁরা করেন, তাঁরা রাজনৈতিক ভাবে লড়েন। আর অপরিশোধিত রাজনীতিতে বিশ্বাসীরা এ ভাবে তাঁদের অঙ্গুলিহেলনে কাজ করা দুষ্কৃতীদের দিয়ে এ সব করান। প্রতিবাদের ভাষার মধ্যেই একটা অপরিশোধিত ব্যাপার রয়ে যায়। এদের কোনও শিক্ষা হয় না। যুগে যুগে এমনটা হয়ে এসেছে।’’ নৃসিংহপ্রসাদের অভিমত, যারা পাথর ছুড়ছে, তাদের নিজস্ব কোনও বোধ নেই। তাঁর কথায়, ‘‘ঠিক যেমন রাজ্য সরকার যখন টেট স্বাভাবিক ও সতর্ক ভাবে করা হবে জানানোর পরেও এক দল লোক মামলা ঠুকে দেয়! এটাও তেমন। এত সুন্দর একটা ট্রেন, আমি পাথর ছুড়লাম। এর সঙ্গে বাঙালির কোনও যোগ নেই। এটা সামাজিক ব্যাধি।’’

তবে ‘ব্যাধি’ শব্দটি নিয়ে আপত্তি রয়েছে মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তাঁর মতে, ‘ব্যাধি’ কারও নিয়ন্ত্রণে থাকে না। কিন্তু এই পাথর ছোড়ার মতো ঘটনায় তো নিয়ন্ত্রণে থাকে মানুষের। তাঁর কথায়, ‘‘এই ঘটনা কোনও দলীয় রাজনীতির কারণে হয়েছে কি না, জানি না। ট্রেনে পাথর ছোড়া তো বন্দে ভারতের আগেও ঘটেছে। এটা দলীয় সংঘাতের কারণে প্রতীকী প্রতিবাদ হিসাবে হল কি না এ কথা অনুসন্ধানসাপেক্ষ। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, যে ক’টি পাথর বন্দে ভারতের গায়ে লেগেছে, সেগুলি যারা ছুড়েছে, তাদের ব্যক্তিত্ব আলাদা, ইতিহাস আলাদা। অতএব কারণ অবশ্যই আলাদা হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।’’

অনুত্তমার মতে, কোনও আচরণ বোঝার ক্ষেত্রে সার্বিকীকরণের দিকে না ঝোঁকাই শ্রেয়। সকলের মানসিক অবস্থানকে ধরাও যায় না। এই ধরনের আচরণকে অনুত্তমা সমর্থন করেন না। ঘটনার ব্যাখ্যা করা মানেই তাকে সমর্থন করা নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘অনেক ব্যক্তিগত ক্ষোভ, অবদমিত রাগ থেকেও অনেক সময় সুন্দরের প্রতি ক্ষোভ উঠে আসতে পারে। সুন্দরের প্রতি আমাদের অধিকারেরও তো শ্রেণি বিভাজন রয়েছে।’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘আমরা পাওয়ার যোগ্য কি না সে প্রশ্নের পাশাপাশি যা পাওয়ার যোগ্য ছিলাম, পেলাম কি না, এই প্রশ্নও কি রাখা যায় না!’’ মনোবিদের মতে, ‘‘ট্রেনে পাথর ছোড়া এমন একটা বিষয়, যেখানে আমার রাগটা কোথাও একটা প্রকাশ পেল বটে। কিন্তু যে ছুড়ল, তার দিকে চোখ পড়ল না। অর্থাৎ, রাগের দৃশ্যমানতা হল। কিন্তু ক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা গেল না।’’

প্রাক্তন পুলিশ কর্তা সন্ধি মুখোপাধ্যায় যদিও গোটা বিষয়টির তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কাউকে নিশ্চিত ভাবে দায়ী করতে চান না। বিষয়টি ‘রাজনৈতিক’ কি না, তা-ও বলতে চান না। তাঁর কথায়, ‘‘এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা না কি এর পিছনে রাজনৈতিক মতলব রয়েছে, সেটা প্রথমে জানতে হবে। এটা কেন্দ্রীয় ভাবে করা হচ্ছে, না কি স্থানীয় রাজনীতির খেলা, তা-ও তো জানতে হবে। অনেকে বলছেন, এ রাজ্যের শাসকদল নাকি এটা করাচ্ছে! কারণ ট্রেনটা কেন্দ্রের। আমার প্রশ্ন অন্য— মুখ্যমন্ত্রী নিজে থেকেছেন যে ট্রেনের উদ্বোধনে, সেই ট্রেনে তাঁর দলের লোক হামলা চালাবে, এটা কি ভেবে নেওয়া উচিত হবে? সব দিক থেকে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন প্রথমে।’’ একই সঙ্গে সন্ধি জানাচ্ছেন, এর সঙ্গে আমরা ভাল কিছু পাওয়ার যোগ্য কি না সে প্রশ্ন তোলা ঠিক নয়। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা ভাল কিছু পাওয়ার যোগ্য কি না, তা এই ঘটনা দিয়ে বিচার করা ঠিক নয়। এত বড় কথা বলাটাও ঠিক হবে না। নীতিগত ভাবে ঠিক হবে না। তদন্তটা খুব গুরুত্ব দিয়ে করা দরকার।’’

রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব অর্ধেন্দু সেন আবার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরলেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমার তখন আট-দশ বছর বয়স। যে ট্রেনে যাচ্ছিলাম, কেউ তার জানলার কাচে পাথর ছোড়ে। কাচ ভেঙেছিল। গায়ে চোট লাগেনি। কিন্তু মনের চোট এখনও যায়নি। মাঝে বহু দিন শুনিনি এ কথা। আবার শুনে খারাপ লাগল। স্রেফ রাজনীতি? না কি সত্যিই আমরা আমাদের আনন্দে, অগ্রগতিতে, উন্নতিতে সবাইকে সামিল করতে পারছি না?’’

শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহার বিশ্বাস করেন, পাথর ছোড়ার এ কাজ বাংলার মানুষ করেনি। তাঁর কথায়, ‘‘এর মধ্যে রাজনীতির খেলা আছে। গোটা দেশ জুড়েই রাজনৈতিক বিরোধিতার একটা পরিমণ্ডল তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে যেন কোনও সহযোগিতার সম্পর্ক থাকছে না। শুধুই বিরোধিতার সম্পর্ক থাকবে। একটি দল ভাল কাজ করলে অন্য দল তার মন্দটাকেই দেখবে। ভালটা দেখতে ভুলেই যাচ্ছে। গোটা দেশেই তাই চলছে। বাংলাতেও সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি চলছে।’’

মীরাতুনের মতোই গোটা ঘটনায় ‘রাজনীতি’ দেখছেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। তাঁর কথায়, ‘‘বার বার এমন ঘটনা ঘটলে বাংলা এই ধরনের কিছু পাওয়ার যোগ্য কি না, সে প্রশ্ন তো ওঠেই। কারণ, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একই ভাবে ঘটছে। বোঝা যাচ্ছে সংগঠিত। এর পিছনে কোনও বার্তা রয়েছে। ব্যবস্থা না নিলে বাংলার আরও সর্বনাশ হবে। বন্দে ভারতের মতো দেশের অহঙ্কার যেখানে নিরাপদ নয়, সেই রাজ্যের দিকে শিল্পপতিরা ফিরেও তাকাবেন না।’’

রাজনীতির কথা মেনে নিচ্ছেন রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যও। তাঁর কথায়, ‘‘পরিকল্পনামাফিক বাংলাকে খাটো করে দেখার জন্যই এই পরিকল্পনা। এর পিছনে রাজনীতি রয়েছে। তবে এ সব করে বাংলার গরিমা নষ্ট করা যায় না। আর সব কিছু ভালর পাওয়ার যোগ্য একমাত্র বাংলাই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Vande Bharat Indian Rail Indian Railways
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE