অতনু ঠাকুরের (ইনসেটে) মা-বাবা। শর্বরীদেবী এবং অসীমবাবু। তাপস ঘোষের তোলা ছবি।
দুর্ঘটনায় মৃত বসিরহাটের স্বর্ণেন্দু রায়ের অঙ্গদানের সিদ্ধান্ত নিতে বিন্দুমাত্র সময় নেয়নি তাঁর পরিবার।
তাদের দেখানো পথেই একমাত্র ছেলেকে হারানোর শোক ভুলে সামাজিক সচেতনতার নজির রাখল চুঁচুড়ার এক পরিবারও।
চলতি মাসের ৪ তারিখে স্বর্ণেন্দুর ‘ব্রেন ডেথ’-এর পরে তাঁর অঙ্গগুলি কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতাল থেকে এসএসকেএমে দ্রুত পৌঁছতে ‘গ্রিন করিডর’-এর ব্যবস্থা করেছিল কলকাতা পুলিশ। চুঁচুড়ার ৩ নম্বর ফার্ম সাইড রোডের বাসিন্দা, কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী অসীম ঠাকুরের পক্ষে পুলিশ প্রশাসনের এমন সহযোগিতা পাওয়ার সুযোগ হয়নি। কারণ, গত ৫ নভেম্বর তাঁর ছেলে অতনু এ রাজ্যে নয়, পথ দুর্ঘটনায় মারাত্মক জখম হন হায়দরাবাদে। পরের দিন তাঁর ‘ব্রেন ডেথ’ হয়। ততক্ষণে সংবাদমাধ্যমে চলে এসেছে স্বর্ণেন্দুর অঙ্গদান এবং কলকাতায় ‘গ্রিন করিডর’-এর খবর। তা দেখে আর সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি অসীমবাবু ও তাঁর স্ত্রী শর্বরীদেবী। হায়দরাবাদের হাসপাতালেই ছেলের হার্ট, কিডনি, লিভার দান করেন তাঁরা।
অসীমবাবু বলেন, ‘‘আমি দুর্ঘটনার খবর পেয়েই হায়দরাবাদ যাই। ছেলের মৃত্যুর কথা জেনে স্ত্রী-ই আমাকে অঙ্গদানের কথা বলে। সেই সময় টিভিতে স্বর্ণেন্দুর খবর দেখাচ্ছিল। আমি রাজি হয়ে যাই।’’ শর্বরীদেবী বলেন, ‘‘স্বর্ণেন্দুর মতো আমার ছেলের অঙ্গ নিয়েও তো কেউ বাঁচল! এটাই সান্ত্বনা। হাসপাতাল বলেছে, চার জনের দেহে ছেলের অঙ্গ প্রতিস্থাপন হয়েছে। ওঁদের মধ্যেই ছেলে বেঁচে থাকবে।’’ তাঁরা যে একটি পরিবারকে অঙ্গদানে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছেন, তা জানতে পেরে স্বর্ণেন্দুর বাবা চন্দ্রশেখর রায় বলেন, ‘‘শুনে ভাল লাগছে। আমার ছেলের মতো ওই ছেলেটিও অন্যদের মধ্যে বেঁচে থাকবে।’’
৩০ সেপ্টেম্বর হায়দরাবাদের একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরিতে যোগ দেন বছর ছাব্বিশের অতনু। তাঁর পরিবার সূত্রে খবর, ৫ নভেম্বর রাতে অফিস থেকে বেরিয়ে অতনু বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলেন। ফেরার সময় কোন্ডাপুরের কাছে রাস্তা পেরোতে গিয়ে গাড়ির ধাক্কায় জখম হন। হায়দরাবাদের একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। খবর পেয়েই সেখানে যান অতনুর বাবা। পরের দিন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অতনুর ‘ব্রেন ডেথ’-এর কথা ঘোষণা করেন। সে কথা চুঁচুড়ায় স্ত্রীকে জানান অসীমবাবু। স্ত্রীর পরামর্শেই ছেলের অঙ্গদানের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অঙ্গদানের প্রক্রিয়া সারলে হায়দরাবাদেই ছেলের দেহ দাহ করে ৮ নভেম্বর চুঁচুড়ায় ফেরেন অসীমবাবু।
অঙ্গদান নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করে, হুগলির এমন সংগঠনগুলি অসীমবাবুদের উদ্যোগের কথা জেনে সাধুবাদ জানিয়েছে। ‘শ্রীরামপুর সেবাকেন্দ্র ও চক্ষুব্যাঙ্ক’-এর সাধারণ সম্পাদক দিলীপ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ওই পরিবারকে ধন্যবাদ। রাজ্যের নানা এলাকা থেকে অঙ্গদানের নজির সামনে আসছে। মানুষের সচেতনতা বাড়ছে।’’ জাঙ্গিপাড়ার একটি সংগঠনের সদস্য সুরজিৎ শীল বলেন, ‘‘এমন দৃষ্টান্ত যত সামনে আসে, তত ভাল।’’
একমাত্র ছেলের মৃত্যুর পর অসীমবাবু এখনও কাজে যোগ দেননি। কয়েক বছর পরেই তিনি অবসর নেবেন। তাঁর কথায়, ‘‘ছেলের স্বপ্ন ছিল, ভাল চাকরি করে প্রতিষ্ঠিত হবে। ভাল চাকরি ও পেল। কিন্তু জীবন চলে গেল। ওর অঙ্গ নিয়ে অন্যেরা ভাল থাকুক, এটাই কামনা করি।’’
স্বর্ণেন্দুর মতো অতনুও বেঁচে থাকছেন অন্যদের মধ্যে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy