প্রতীকী ছবি।
লাও তো বটে, কিন্তু আনে কে?
মিড-ডে মিলের নতুন মেনু দেখে ক’দিন ধরেই স্কুলের বারান্দা থেকে টিচার্স রুমে চাপা গুঞ্জন ছিল, বাঁধা বরাদ্দে, ভাত, আলুপোস্ত, আস্ত ডিম, মাছের ঝোল, পাঁপড়, চাটনি— এমন বাহারি পদের সামাল দেওয়া যাবে কী করে, বরাদ্দ তো শিকলে বাঁধা!
পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মিড-ডে মিলের বরাদ্দ ৪.৪৮ টাকা। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম ৬.৭১ টাকা। তাতে এই এলাহি আয়োজন হবে কী করে? সোমবার মুখ্যমন্ত্রী অভয় দেওয়ার আগে মাথা চুলকোচ্ছিলেন প্রধান শিক্ষকেরা!
কিন্তু ওদের? সীমান্তের গাঁ-গঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খোঁয়াড়ে উঁকি মারলে ছবিটা বেমালুম বদলে যাচ্ছে।
পঞ্চায়েত বা পুরসভার আওতায় থাকা সেই সব খোঁয়াড়ে গরু-মোষের জন্য নিত্য বরাদ্দের অঙ্ক ১২০ থেকে ১৫০ টাকা! মুর্শিদাবাদের ডোমকল থেকে সুতি, জলঙ্গি থেকে ভগবানগোলা, পদ্মা পার করে পাচার করার মুহূর্তে সীমান্তরক্ষীর হাতে আটক গরু খোঁয়াড়ে পাঠালে তার জন্য দৈনিক খরচের বরাদ্দ এমনই।
সীমান্তরক্ষীদের হাত ঘুরে আটক সেই গরু থানার চত্বরে থইথই করতে থাকলে হালে তাদের পাঠানো হচ্ছে স্থানীয় খোঁয়াড়ে। জঙ্গিপুরের এসডিপিও প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “এ বড় হ্যাপা, বুঝলেন! পাচারের মরসুমে বিএসএফ গরু ধরলেই পাঠিয়ে দিচ্ছে থানায়। কিন্তু থানা তো আর গরুর গোয়াল নয়!’’ তাই গো-মাতাদের ঠাঁই হচ্ছে স্থানীয় খোঁয়াড়ে। দু’টো-পাঁচটা থেকে সেই আটক গরুর সংখ্যাটা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন হাজারের বেশি। পঞ্চায়েতের নিয়ম মেনে পুলিশকে এখন নিত্য খোঁয়াড় মালিকের হাতে গরু প্রতি রাহা খরচ হিসেবে ১৩০ টাকা করে তুলে দিতে হচ্ছে।
বরাদ্দ
মিড-ডে মিল (পড়ুয়া-পিছু)
• পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত: ৪ টাকা ৪৮ পয়সা
• ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি: ৬ টাকা ৭১ পয়সা
(খরচ যৌথভাবে কেন্দ্র এবং রাজ্যের)
খোঁয়াড়ে
• প্রতিটি গরু অথবা মোষ-পিছু দৈনিক: ১২০ থেকে
১৫০ টাকা!
• খোল, ভুসি, গুড়: ২০ টাকা কেজি দরে আট থেকে দশ কেজি
• খড় ও ঘাস: ২ টাকা কেজি দরে ৩০ কেজি
• সেই সঙ্গে রয়েছে রাখালের খরচও
(এ ক্ষেত্রে খরচ পুলিশের)
ওই পুলিশ কর্তা বলছেন, ‘‘খরচের বহরটা বুঝতে পারছেন!’’ হাড় জিরজিরে সেই গরুকুল খোঁয়াড়ের রোদ্দুরে শুকোচ্ছে। খোঁয়াড় মালিক জামাল শেখ বেজার মুখে বলছেন, ‘‘আগে তো মেরে কেটে পাঁচ-সাতটা গরু আসত। এখন এতগুলো গরু দেখভাল করতে হচ্ছে। ৬০ জন রাখাল রাখতে হয়েছে। প্রত্যেককে মাসে আট হাজার টাকা বেতন দিতে হচ্ছে। গরুকে খাওয়াতে বিপুল টাকা খরচ হচ্ছে। এ দিকে, টাকার দেখা নেই। সরকারের টেবিল ঘুরে টাকা আসতে তো বছর ঘুরে যাচ্ছে।’’
কোথায় মিড-ডে মিল, কোথায় খোঁয়াড় বরাদ্দ— এমন তফাৎ কেন?
রাজ্যের প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের প্রাক্তন কর্তা স্বপন শূর খেই ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘পূর্ণবয়স্ক একটি গরুর দিনে আট-দশ কেজি খোল লাগে। সঙ্গে ভুসি, গুড়। নিম্নমানের হলেও যার দাম কেজি প্রতি ২০ টাকা। খড় ও ঘাস লাগে দিনে ৩০ কেজি। ২ টাকা কেজি, মানে দাম ৬০ টাকা।’’ সে টাকার জোগান দিতে হচ্ছে পুলিশকে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে অবশ্য জানা গিয়েছে, আটক গরু ছাড়াতে গেলে গরুর মালিককেই সে খেসারত দিতে হয়। কিন্তু পাচারের আটক গরুর ক্ষেত্রে সে প্রশ্ন নেই। গৌরী সেন হয়ে সে ব্যয় সামাল দিতে হচ্ছে উর্দিধারীকেই!
পুলিশ জানিয়েছে, আগে আটক করা গরুর কোনও দাবিদার না থাকলে নির্দিষ্ট সময়ের পরে নিলাম করা হত। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গত দেড় বছর ধরে তা বন্ধ। ফলে আটক করা গরু রাখতে হচ্ছে খোঁয়াড়ে। জঙ্গিপুর আদালতের আবেদন করে শ’চারেক গরু আপাতত পাঠানো হয়েছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার গোশালায়। কিন্তু বাকিরা? প্রসেনজিৎবাবু বলছেন, ‘‘কী বলব বলুন? গচ্চা গুনছি!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy