Advertisement
E-Paper

ধর্মে ধর্মে, জাতিতে জাতিতে ভয়ঙ্কর ভুল বোঝাবুঝি বড় সমস্যা, বললেন অমর্ত্য সেন

আজকের এই ভারতের সঙ্কটের সমাধান সূত্র হিসাবে অমর্ত্য ঘুরে-ফিরে গান্ধী, সুভাষচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথদের আদর্শের কথা বলেছেন। ক্ষিতিমোহন-কথিত ধর্মে-ধর্মে যুক্ত সাধনার কথাও উঠে এসেছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২৩ ০৬:৪৭
কলকাতায় অমর্ত্য সেন। রবিবার। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

কলকাতায় অমর্ত্য সেন। রবিবার। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

এক ঝাঁক স্কুলপড়ুয়ার সামনে তাঁর নিজের মেয়ের স্কুলের গল্প শোনাচ্ছিলেন অমর্ত্য সেন। তাঁর বড় মেয়ে অন্তরা তখন পাঁচ বছরের। কলকাতার নামী স্কুলে কন্যাকে নিয়ে যেতেই নানা রঙের এটা-সেটা দেখিয়ে রং চেনানোর পরীক্ষা নিলেন শিক্ষক। মেয়ের কিন্তু মুখে কুলুপ! ব্যাজার মুখে তার হাত ধরে সেই ঘর থেকে বেরোতেই কন্যার উক্তি, ‘আচ্ছা বাবা, ওই টিচার কি কালার ব্লাইন্ড (বর্ণান্ধ)?’

মেয়ের ছোটবেলার মজাদার গল্পে আজকের পৃথিবীর গভীর অসুখের কথাই বলতে চেয়েছেন অমর্ত্য। কে, কাকে, কেন, কী বলছে বোঝা মোটেও সহজ নয়! সল্টলেকে ‘অমর্ত্য সেন রিসার্চ ইনস্টিটিউটে’ বৈচিত্র্যে সমন্বয় শীর্ষক আলাপচারিতার আসরে অমর্ত্য বললেন, “দুনিয়া জুড়েই জনে জনে মানসিক যোগাযোগের পথে কাঁটা। ধর্মে ধর্মে, জাতিতে জাতিতে ভয়ঙ্কর ভুল বোঝাবুঝিও বড় সমস্যা। এর জন্য পরস্পরের বিষয়ে অশিক্ষা, অজ্ঞানতাও দায়ী।”

প্রতীচী ট্রাস্ট এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সংযোগের মঞ্চ ‘নো ইয়র নেবর’-এর উদ্যোগে আলোচনা-সভাটির ধরতাই বেঁধে দেওয়া হয় অমর্ত্যের প্রিয় মাতামহ ক্ষিতিমোহন সেনের বহুল পরিচিত একটি লব্জ ধার করে। শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন উপাচার্য, রবীন্দ্রসহচর এবং সংস্কৃতের প্রগাঢ় পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন ভারতে হিন্দু-মুসলিমের কয়েক শতাব্দীর ভাব সম্মেলনে অসামান্য ঐশ্বর্য সৃষ্টির উৎকর্ষে বিশ্বাস করতেন। ভারতে এই দুই ধর্মের ধারার সমন্বয়কে ‘যুক্ত সাধনা’ আখ্যা দেন তিনি।

সাহিত্য, স্থাপত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলার মতো নানা ক্ষেত্রে এই যুক্ত সাধনা নিয়ে ক্ষিতিমোহনের বিখ্যাত প্রবন্ধের বিষয়ে সভায় ধরতাই দেন বিশ্বভারতীর বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক বিশ্বজিৎ রায়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ, বিদ্বেষের পটভূমিতে ‘যুক্ত সাধনা’র কথা মনে করিয়েছিলেন ক্ষিতিমোহন। আজকের ভারতেও বার বার তার প্রাসঙ্গিকতার কথা উঠে এসেছে পড়ুয়া, শিক্ষকদের নানা প্রশ্নে।

নোবেলজয়ী চিন্তাবিদ বলেন, “ভারতে এমন অবস্থা কিন্তু কখনও খুব বেশি দিন চলেনি, যখন ধর্মের নামে লোকজনকে মারধর করা হচ্ছে এবং তাঁদের কথাগুলো শুনতেও আমাদের তীব্র আপত্তি চোখে পড়ছে। মানুষকে মর্যাদা দেওয়ার ক্ষমতা কমেছে বলেই আমরা পিছিয়ে পড়ছি।”

আজকের এই ভারতের সঙ্কটের সমাধান সূত্র হিসাবে অমর্ত্য ঘুরে-ফিরে গান্ধী, সুভাষচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথদের আদর্শের কথা বলেছেন। ক্ষিতিমোহন-কথিত ধর্মে-ধর্মে যুক্ত সাধনার কথাও উঠে এসেছে। তবে সহাস্য অমর্ত্য বলেন, “এই যোগাযোগের সুরটা খুব গম্ভীর হতেই হবে, তা নয়!”

ক্ষিতিমোহনের দাদা ফার্সিবিদ অবনীমোহন ফি-সন্ধ্যায় এক ‘মুসলমান পুরোহিত’ বন্ধুর সঙ্গে আড্ডায় জমিয়ে তামাক খেতেন। একদিন জনৈক হিন্দু পুরোহিত তা দেখতে পেলেন। মুসলিম বন্ধুটি ওই হিন্দু পুরোহিতকেও তামাক-আসরে যোগ দিতে ডেকেছিলেন। তিনি দ্বিধা করলে তাঁকে বুঝিয়ে বলেন, ‘আপনি কখনও ভেবে দেখেছেন যে, আসলে আমাদের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নেই! আপনি গরিব হিন্দু, আমি গরিব মুসলমানের মাথায় হাত বুলিয়েই অর্থ উপার্জন করি, কিছু পার্থক্য থাকলেও দু’জনের ব্যবসা এক।”

মাতামহের কাছে শোনা সরস গল্পটির সূত্র ধরেই অমর্ত্য এ দিন স্কুল, কলেজের আগামী প্রজন্মকে বোঝাতে চেয়েছেন, এ দেশে ধর্মের বেড়া ভেঙে মেলামেশার রূপরেখাটি সহজ, সরল হওয়া উচিত। বিভাজন-কাঁটায় বিদ্ধ দেশে শিক্ষকদের হাল ছাড়তে বারণ করে অমর্ত্যের পরামর্শ, “আশাবাদ খুঁজতে যাবেন না। মূল্যবোধে ভরপুর ভাল কাজের মধ্যে আশা সঞ্চার করুন। অনেকটা যেমন আশা ফুটবল মাঠের দাপাদাপিতে মিশে থাকে।”

Amartya Sen Kolkata
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy