—নিজস্ব চিত্র।
অসুস্থ ছিলেন গত কয়েক বছর। বিশপ লেফ্রয় রোডের বিখ্যাত বাড়িতেই ঘরবন্দি হয়ে কাটছিল শেষ কয়েক বছর। সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে চার দিন বেলভিউ নার্সিং হোমে থাকার পর মঙ্গলবার বিকেলে মারা গেলেন সত্যজিৎ-পত্নী বিজয়া রায়। এ বারই ৯৯ বছরে পা দেওয়ার কথা ছিল তাঁর।
প্রায় শতায়ু বিজয়া রায়ের পরিচিতি কি শুধুই সত্যজিৎ-পত্নী হিসাবে? প্রতিভাবান স্বামীর প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী’র জন্য যিনি গায়ের গয়না দিতেও কুণ্ঠিত হননি? সম্ভবত, বিজয়া রায়ই স্বাধীনতার পরে প্রথম বাঙালি কন্যা যিনি ১৯৪৯ সালে কাজিন প্রেমিককে বিয়ে করছেন, দু’ জনকেই এই কৌতূহলী বাঙালি সমাজে সেই ঘটনা চেপে রাখতে হচ্ছে। ‘রিভার’ ছবির সময়েও জঁ রেনোয়া সত্যজিৎ রায়কে তাঁর ছবি উপহার দিয়ে লিখছেন, ‘মানিক রায়কে, যাকে বিবাহিত দেখলে খুশি হব।’ সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিকূলতার চাপে মানিক রায় ও তাঁর স্ত্রীকে যে কী ভাবে প্রথম কয়েক মাস নিজেদের রেজিস্ট্রির কথা চেপে রাখতে হয়েছিল, রেনোয়া জানতেন না। বিজয়া রায় নিজেকে আড়ালে রেখে শেষ অবধি সুকুমার ও সুপ্রভা রায়ের পুত্রবধূ, সত্যজিৎ রায়ের পত্নী, সন্দীপ রায়ের মা ইত্যাদি পরিচিতিই মেনে নিয়েছিলেন। নইলে আত্মজীবনীর নাম ‘আমাদের কথা’ রাখবেন কেন? সত্যজিতের বেশির ভাগ ছবির লোকেশন দেখা থেকে কস্টিউম ডিজাইনিং তাঁর হাত ধরে। বালক অপুকে খুঁজে বের করা কিংবা প্রথম স্ক্রিন টেস্টের জন্য ‘অপর্ণা’ শর্মিলা ঠাকুরকে সাজিয়ে দেওয়া সবই তাঁর সৌজন্যে। সত্যজিৎ বরাবরই ‘মানিকদা’ কিন্তু বিজয়া রায় ইউনিটের খুদে অভিনেতাদের কাছে ‘মঙ্কুমাসি’ও হয়ে যেতেন। সত্যজিতের ঘরে ফিল্ম বা সন্দেশ পত্রিকার আড্ডা কি সম্ভব হত বিজয়া রায়ের প্রচ্ছন্ন গৃহিণীপনা ছাড়া?
এর মধ্যে অনেকে ব্রাহ্ম পরিবারের ঐতিহ্য খুঁজে পেতে পারেন। কিন্তু সেটিই কি সব? পটনার ব্যারিস্টার চারুচন্দ্র দাস ও মাধুরী দেবীর কন্যা বিজয়া দাস সুন্দরী, গানের গলা অসাধারণ। গানের জন্যই বাবা তাঁকে প্যারিস পাঠাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর অকালমৃত্যুতে সব থমকে যায়। চলে আসতে হয় কলকাতায় কাকা প্রশান্ত দাসের বাড়িতে। এখানেই সত্যজিতের সঙ্গে তাঁর আলাপ। সিনেমা, পাশ্চাত্য সঙ্গীত এবং আরও অনেক কিছু দু’ জনকে এক হাইফেনে জুড়েছিল। মারি সিটনের লেখা জীবনীতে তরুণ বয়সে সত্যজিতের আঁকা বিজয়া রায়ের ছবিটি অনেকেরই মনে পড়বে। ১৯৪৪ সালে ‘শেষরক্ষা’ ছবিতে নায়িকার ভূমিকাতেও ছিলেন বিজয়া।
এখানেই বিজয়া রায়। চারের দশকে প্রবাসী এনলাইটেন্ড কন্যা, যিনি সিনেমায় নামেন, বাড়ি থেকে প্যারিসে গিয়ে সঙ্গীতশিক্ষার স্বপ্ন দেখেন। বয়সে ছোট এবং কাজিন প্রেমিককে জীবনসঙ্গী নির্বাচিত করতে পিছপা হন না। একদিকে মেয়েদের নতুন জীবনের ইঙ্গিত, অন্য দিকে সত্যজিৎ-ঘরণীর পরিচিতিতেই জীবনের ফুলদানি সাজিয়ে নেওয়া। নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারাটাই বোধহয় বিজয়া রায়ের কাছে ছিল সবচেয়ে বড় শিল্প।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy