সমুদ্রের ধার থেকে সটান এভারেস্ট বেস ক্যাম্প। তা-ও আবার সাইকেলে! ১৩৪৬ কিলোমিটার পথ পেরোতে লেগেছে ২৯ দিন। সমুদ্র-সমতল থেকে পাহাড়ি নেপালের চড়াই-উতরাই ভেঙে গত সোমবার এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে পৌঁছে
এই অভিনব অ্যাডভেঞ্চার-পর্ব শেষ করলেন নদিয়ার করিমপুরের জ্যোতিষ্ক বিশ্বাস।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি সকালে দিঘা থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন আটাশ বছরের এই তরুণ তুর্কি। সঙ্গী হিসাবে ছিল প্রিয় সাইকেল ‘রীতিকা’। এর পরে কলকাতা, শিলিগুড়ি,
ইতাহারি, পোঙ্গলদুঙ্গা, সাল্লেরি, নামচেবাজার, প্যাংবোচে, গোরখশেপ ছুঁয়ে অবশেষে পৌঁছনো এভারেস্ট বেস ক্যাম্পের সামনে। ‘‘সমুদ্র সমতল থেকে ৫৩৬৪ মিটার উচ্চতার এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে পৌঁছতে যা চড়াই-উতরাই ভাঙতে হয়েছে, তা প্রায় দুটো এভারেস্টের উচ্চতার সমান! এর মধ্যে মাত্র ৬০ শতাংশ রাস্তায় সাইকেল চালাতে পেরেছি। বাকিটুকুতে রাস্তা বলে কিছু নেই, ফলে সাইকেল ঘাড়ে করেই এগোতে হয়েছে।’’— বেস ক্যাম্প থেকে নামার পথে মঙ্গলবার ফোনে বললেন জ্যোতিষ্ক।
পাহাড়ের টানেই কম বয়স থেকে ট্রেকিং, সাইক্লিংয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন জ্যোতিষ্ক। কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর, মঙ্গোলিয়ায় সাইকেল চালিয়ে এসেছেন তিনি। এ ছাড়া, ট্রেকিং সংস্থা চালানোর সুবাদে প্রায়ই পাহাড়ে ট্রেক করেন। তবে দিঘা থেকে এভারেস্ট বেস ক্যাম্প পর্যন্ত সাইকেল অভিযানের ভাবনা তাঁর মাথায় এসেছিল ‘সামিট অব দ্য গডস’ অ্যানিমেশন সিনেমাটি দেখতে দেখতে। সেখানে ‘হাবু’ চরিত্রের মতোই সাইকেল নিয়ে খুম্বু এলাকা নিজের চোখে দেখার ভাবনার শুরু। প্রথম থেকেই উৎসাহ জুগিয়ে এসেছিলেন বাবা নীতীশকুমার বিশ্বাস। তবে, সাগরমাথা জাতীয় উদ্যানে যে সাইকেল-সহ যে কোনও রকম যান নিয়ে প্রবেশে সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে, তা আগে তেমন জানা ছিল না তাঁর। সেই বাধা টপকানো সম্ভব হল কী ভাবে? জ্যোতিষ্কের কথায়, ‘‘সাইকেল তো পরিবেশবান্ধব যান। তাই এটাও আটকাবে, তা আগে ভাবিনি। সাল্লেরি চেকপোস্টে পৌঁছে জানতে পারি, পারমিট ছাড়া সাইকেল নিয়ে এগোনো যাবে না। সেখানে দু’দিন সময় নষ্ট হয়। এর পরে নেপালের একটি ট্রেকিং সংস্থা কাঠমান্ডু থেকে সেই পারমিট করিয়ে দেয়। এ জন্য অবশ্য অনেকটাই টাকা গুনতে হয়েছে। পথে প্রায় সর্বত্র সেই পারমিট দেখতে চেয়েছে সেনা। তখন বুঝেছি, ওটা না থাকলে অনেক বেশি সমস্যা হত।’’
তবে চড়াই-উতরাইয়ের বাধা পেরোতে হয়েছে সাইকেল ঘাড়ে করেই। জ্যোতিষ্কের দাবি, নিয়মিত ট্রেকিং ও পাহাড়ি পথে দৌড়নোর অভ্যাস থাকায় সাইকেল কাঁধে আরোহণ তেমন কঠিন মনে হয়নি তাঁর। বরং এই কারণে বহু দেশি-বিদেশি সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছে। ‘‘তবে এটা ঠিক, ট্রেকারেরা পাশ কাটিয়ে চলে গেলেও সাইকেল নিয়ে উঠতে বেশি সময় লেগেছে আমার। ধসপ্রবণ এলাকা একা পেরোতে হয়েছে। অনেক জায়গাতেই মনে হয়েছে, একটু অন্যমনস্ক হলেই নীচে খাদে তলিয়ে যেতে পারি। কখনও ১০ মিটার পরে পরেই বড় বড় পাথর টপকাতে হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রবল ঠান্ডা। সোমবার গোরখশেপে মাইনাস ২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা ছিল। এমতাবস্থায় শরীরকে গরম রেখে এগিয়ে যাওয়াটাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।’’— বলছেন যুবক।
জ্যোতিষ্কের এই অভিযানে নানাবিধ ভাবে সাহায্য করা, এভারেস্টজয়ী পর্বতারোহী মলয় মুখোপাধ্যায় নিজেও সম্প্রতি ভিয়েতনামে সাইক্লিং করে ফিরেছেন। তাই এই অভিযানের সাফল্যের পিছনে জ্যোতিষ্কের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, হার না-মানা মানসিকতার প্রশংসা করছেন মলয়। বলছেন, ‘‘সাইকেল নিয়ে বেস ক্যাম্প পর্যন্ত পৌঁছনো বড় কৃতিত্বের দাবি রাখে। মনের জোর থাকলে মানুষ কী না করতে পারে, এটা তার
বড় উদাহরণ। অ্যাডভেঞ্চারের দিক থেকে একটা বড় ব্যাপার, তাতে
সন্দেহ নেই।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)