Advertisement
E-Paper

জানিলা অদ্বৈত কৈল প্রভুর প্রকাশ পরীক্ষিতে চলিলেন শান্তিপুর বাস

নানা কাহিনির আশ্রয় নদিয়া। সাহিত্যের মতো শাস্ত্রও সাদরে বরণ ও লালন করেছে সেই সব কাহিনিকে। সেই কাহিনিতে কখনও কেন্দ্রে থাকেন কোনও রাজা। কখনও বিদ্বান। তাঁদের আচরণ ও ধর্মে সৃষ্টি হয় সমাজবিদ্যার নানা পাঠও। তেমনই এক শহর শান্তিপুর। পঞ্চদশ শতকেই শাস্ত্রচর্চার জন্য যে শহরের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বাংলায়। সুদূর শ্রীহট্ট থেকে যে টানে এই শহরে চলে এসেছিলেন মেধাবী পণ্ডিতেরা। শহরের সেই কাহিনিগুলিরই খোঁজে নেমেছেন অলখ মুখোপাধ্যায় ও দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়।নবদ্বীপ যেমন মধ্যযুগে বিদ্যাতীর্থ বলে খ্যাতি পেয়েছিল, শান্তিপুরও সেই সুনামের অধিকারী ছিল। তবে নবদ্বীপের তুলনায় শান্তিপুরে সম্ভবত অনেক নির্জনে পড়াশোনা করা যেত।

শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০১৬ ০৬:৫১
শান্তিপুের চৈতন্য। প্রাচীন চিত্র। সত্যনারায়ণ গোস্বামীর সৌজন্যে।

শান্তিপুের চৈতন্য। প্রাচীন চিত্র। সত্যনারায়ণ গোস্বামীর সৌজন্যে।

নবদ্বীপ যেমন মধ্যযুগে বিদ্যাতীর্থ বলে খ্যাতি পেয়েছিল, শান্তিপুরও সেই সুনামের অধিকারী ছিল। তবে নবদ্বীপের তুলনায় শান্তিপুরে সম্ভবত অনেক নির্জনে পড়াশোনা করা যেত। নবদ্বীপে যখন শাক্ত ও ন্যায়-স্মৃতি-তর্ক শাস্ত্রের প্রচণ্ড দাপট, তখন শান্তিপুরে বৈষ্ণব ভক্তিরসের চর্চা করা যেত। এটি একটি বড় কথা।

অদ্বৈতের উদাহরণ থেকে বোঝা যা, শান্তিপুরে গীত-নাট্যেরও চর্চা অনেক সহজে করা যেত। যা খাস নবদ্বীপের বুকে করা সম্ভবত শক্ত ছিল। বৃন্দাবনদাসের কাব্যে তার পরিচয় রয়েছে। নবদ্বীপ সম্পর্কে বৃন্দাবন লিখেছেন, ‘‘কৃষ্ণভক্তি ব্যাখ্যা কার না আইসে জিহ্বায় / কুতর্ক খুসিয়া সব অধ্যাপক মরে।।’’ বোঝা যায়, নবদ্বীপে তখন তর্কশাস্ত্রের অবিসংবাদী প্রভুত্ব। কিন্তু বৃন্দাবন কথিত ‘কৃষ্ণভক্তি ব্যাখ্যা’র মধ্যে রয়েছে এক ধরনের শাস্ত্র অনুশীলনও, যার অঙ্গ হল গীত ও নাট্য। গীতবাদ্যে ধরা আবেগের এই অনুশীলনে অনুভূতির প্রচণ্ড প্রকাশও সম্ভব ছিল। যে কারণেই কৃষ্ণভক্তি রসে মূর্চ্ছা নবদ্বীপে অনুমোদনের যোগ্য না হলেও, শান্তিপুরে তা মেনে নেওয়া হত। গদাধরকে সঙ্গে নিয়ে অদ্বৈতর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন বিশ্বম্ভর। সেখানে অদ্বৈত মূর্চ্ছা গিয়েছিলেন। তাতে আপ্লুত হয়েছিলেন বিশ্বম্ভরও।

সম্ভবত সেই কারণেই অদ্বৈত নবদ্বীপ থেকে শান্তিপুরে চলে এসেছিলেন। শ্রীহট্ট থেকে আসা পণ্ডিতদের নবদ্বীপেই গঙ্গার ধারে বসবাস স্বাভাবিক ছিল। সেখানেই থাকতেনও তাঁরা। যেমন ছিলেন চৈতন্যের বাবাও। জগন্নাথ মিশ্রের বাড়ি ছিল শ্রীহট্ট থেকে আসা শ্রীবাস পণ্ডিতদের বাড়ির কাছাকাছি। তাঁর বড় ছেলে, বিশ্বম্ভরের দাদা বিশ্বরূপ অদ্বৈতের কাছে পড়াশোনা করতেন। রূপবান সেই মেধাবী যুবক অদ্বৈতর কাছ থেকেই সন্ন্যাসের প্রতি আকৃষ্ট হন। বিশ্বম্ভরের মা শচীদেবীর তেমনই ধারণা ছিল—‘অদ্বৈত সে মোর পুত্র করিলা বাহির।।’ সম্ভবত জগন্নাথ মিশ্রেরও তেমনই ধারণা ছিল। তাই বিশ্বরূপ সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়ার পরে ছোট ছেলে বিশ্বম্ভরকে টোলেই পাঠাতে চাননি জগন্নাথ। এই সময়ের আগেই অদ্বৈত নবদ্বীপ থেকে শান্তিপুরে চলে গিয়েছেন। সুকুমার সেনের ধারণা, সম্ভবত শচী অখুশি হয়েছিলেন বলেই আর নবদ্বীপে থাকতে চাননি অদ্বৈত। শান্তিপুরে বসবাস শুরু করেন। তাঁকে ঘিরে সেখানে নিশ্চিন্তে একটি বৈষ্ণব ভক্ত গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। তাঁরা ভক্তিরসের যে চর্চা করতেন, তাতে কীর্তনেরও অংশ ছিল। নবদ্বীপে কিন্তু কীর্তন করতে হত দরজা এঁটে। তাতেও আপত্তি ছিল।

শহরের লোকজন বলাবলি করত, এরা নিশ্চয়ই ঘরের মধ্যে কোনও মন্দ কাজ করে—‘কেহো বোলে আরে ভাই মদিরা আনিয়া। সভে রাত্রি করি খায় লোক লুকাইয়া।।’ অথবা আরও মারাত্মক—‘রাত্রি করি মন্ত্র পড়ি পঞ্চ কন্যা আনে...এতেকে দুয়ার দিয়া করে নানা রঙ্গ।’’ এমনকী শ্রীবাসের বাড়ির সামনে ভবানী পুজোর সামগ্রী, মদ রেখে গেল গোপাল চাপাল।

মনে রাখতে হবে, নবদ্বীপ ছিল বাণিজ্যকেন্দ্রও। সেখানে নানা ধরনের মানুষ আসতেন নানা জায়গা থেকে। বড় শহরের মতোই নবদ্বীপেরও নানা ভাগ ছিল। কিন্তু সেই ভাগগুলির উপরে প্রবল প্রতাপ ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের প্রভাবও ছিল। বৃন্দাবন তার বিখ্যাত বিবরণ দিয়ে গিয়েছেন। জয়ানন্দও নবদ্বীপের সমাজের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘সর্বলোক হইল শিশ্নোদরপরায়ণ’। তাঁরা তাঁদের মতো করেই বিশ্বম্ভরকে ব্যাখ্যা করতেন। শহরের লোক ভাবতেই পারতেন না, কেউ দুয়ার আঁটা ঘরে শুধু কৃষ্ণনামেই অচেতন হয়ে পড়তে পারেন। ব্রাহ্মণ্য সংস্কারে কৃষ্ণ বড় দেবতা, কিন্তু ‘সর্বশাস্ত্রসার’ নন।

বিশ্বম্ভর, অদ্বৈত যে ভাবে কৃষ্ণকে দেখতেন, তা নবদ্বীপের সংস্কারে অস্বাভাবিক। তাই অদ্বৈত যেমন নবদ্বীপে নিয়মিত আসতেন, বিশ্বম্ভরও প্রায়ই শান্তিপুরে যেতেন। শ্রীবাসকে নিয়ে কখনও হেঁটে, কখনও সাঁতার কেটে গিয়েছিলেন অদ্বৈতের বাড়ি। বয়সে অনেক বড় অদ্বৈতকে মারধরও করেছিলেন। ভক্তিরসের এই প্রচণ্ড অভিঘাত নবদ্বীপে ভাবা যেত না।

নবদ্বীপে রাজার নজরও ছিল বেশি। জয়ানন্দ লিখেছেন, ‘আচম্বিতে নবদ্বীপে হৈল রাজভয়।’ শহর ছেড়ে অনেকে চলে গেলেন। আবার ফিরেও এলেন—‘মহা মহা জন যে ছাড়িয়াছিল গ্রাম। নবদ্বীপ আল্যা সভে হআ পূর্ণকাম।’ বাণিজ্যকেন্দ্র নবদ্বীপের এই যে নানা রূপ, তা থেকে শান্তিপুর দূরে ছিল। বিশ্বম্ভরের সঙ্গে দেখা করতে অদ্বৈত বারবার আসছেন এই শহরে। কিন্তু চলেও যাচ্ছেন—‘জানিলা অদ্বৈত কৈল প্রভুর প্রকাশ। পরীক্ষিতে চলিলেন শান্তিপুর বাস।।’

সন্ন্যাস নেওয়ার পরে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য কাটোয়া থেকে হয় প্রথমে রাঢ় ভ্রমণ করে শান্তিপুরে যান, অথবা জয়ানন্দের মত মতো সমুদ্রগড় হয়ে সোজাই শান্তিপুরে চলে যান। কেন তিনি নবদ্বীপে ফিরলেন না, সে প্রশ্নের নানা উত্তর। তবে শান্তিপুরে অদ্বৈতর বাড়িতেই যে তিনি গিয়ে ওঠেন, তাতে ভক্তিরসের প্রাধান্য শান্তিপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।

সেই শান্তিপুরে এখনও ভক্তিরসের টান রয়েছে।

চৈতন্য নীলাচলে চলে গেলেও অদ্বৈত শান্তিপুরেই ছিলেন। মধ্যম গোস্বামী বা হাটখোলা গোস্বামী বাড়ি অদ্বৈতাচার্যের পৌত্র মথুরেশ গোস্বামীর মধ্যম পুত্র ঘনশ্যাম থেকে সৃষ্টি। ঘনশ্যাম গোস্বামীর পৌত্র রঘুনন্দন ছিলেন এই পরিবারের প্রাণ পুরুষ। জনশ্রুতি রঘুনন্দন গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্রের সেবাইত জনৈক দণ্ডী সন্ন্যাসীর কাছে বেদ অধ্যয়ন করতেন। অধ্যয়ন শেষে শান্তিপুর ফেরার সময় গুরুর কাছে এক সঙ্গে পূজিত দুটি কৃষ্ণবিগ্রহের একটি প্রার্থনা করেন। শিষ্যের প্রার্থনা ফেরাতে না পেরে গুরু দণ্ডী তাঁকে চোখ বন্ধ করে যে কোনও একটি বিগ্রহ স্পর্শ করতে বলেন। রঘুনন্দন চোখ বন্ধ করে যে মূর্তিটি স্পর্শ করেন সেটি গোকুলচাঁদ।

এরপর দণ্ডী গোকুলচাঁদকে তুলে দেন শিষ্যের হাতে। রঘুনন্দন জলপথে গুপ্তিপাড়া থেকে সেই বিগ্রহ শান্তিপুরে নিজের ভদ্রাসনে এনে প্রতিষ্ঠা করেন।

গোকুলচাঁদের মতো এমন নয়নাভিরাম মূর্তি খুব কমই আছে। প্রথম দিকে গোকুলচাঁদও একাকী পূজিত হতেন। পরবর্তী কালে শ্রীরাধিকা যুক্ত হয়েছেন তাঁর সঙ্গে। ১৭৩০-৩৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এখানে তৈরি হয় টেরাকোটার অলঙ্করণ সমৃদ্ধ চমৎকার একটি মন্দির। তবে এই মন্দির নির্মিত হওয়ার আগে থেকেই মধ্যম গোস্বামী বাড়িতে দেবতার মন্দির ছিল। এখানে নিজস্ব মন্দিরে পূজিত হন শ্রীরামচন্দ্র। আছে জগন্নাথ ও বলভদ্রের মূর্তি। রাস, দুর্গোৎসব ও রথ গোকুলচাঁদের প্রধান উৎসব। শান্তিপুর বড়বাজার সংলগ্ন গোকুলচাঁদ মন্দিরে আসতে গেলে স্টেশন থেকে রিকশায় মিনিট পনেরো লাগে। সড়ক পথে শান্তিপুর ডাকঘর বাসস্ট্যান্ড থেকে হাঁটা পথে খুব বেশি হলে মিনিট দশেক।

অদ্বৈতাচার্যের দ্বিতীয় পুত্র কৃষ্ণমিশ্রের পুত্র রঘুনাথ তস্যপুত্র যাদবেন্দ্র গোস্বামী থেকে উদ্ভব মদনগোপাল গোস্বামী বাড়ির। এখানে পূজিত হন শ্রীরাধামদনগোপাল। পরিবারের ইষ্টদেবতার নাম থেকেই বাড়ির নাম মদনগোপাল গোস্বামী বাড়ি। পরিবারের সদস্যদের দাবি গৃহদেবতা মদনগোপাল জীউর অপূর্ব সুন্দর দারু মূর্তিটিই নাকি অতীতে অদ্বৈতাচার্য সেবাপুজো করতেন।

প্রসঙ্গত শান্তিপুরে একমাত্র মদনগোপাল গোস্বামী বাড়িতেই রাধা এবং কৃষ্ণের যুগলমূর্তি দারু নির্মিত। এই বাড়ির পূর্বপুরুষ রাধাবিনোদ গোস্বামীর শ্রীমদ্ভাগবতের টীকা বৈষ্ণব সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।

রাধামদনগোপাল ছাড়াও এখানে নিত্যপুজা হয় সীতানাথের। শান্তিপুর স্টেশন থেকে সোজা পথে পাবলিক লাইব্রেরির বিপরীত গলিতে এই মন্দিরের অবস্থান। রাধা মদনগোপালের নিজস্ব মন্দিরের সামনে রাস মঞ্চে উদযাপিত হয় রাস উৎসব। এ ছাড়াও মাকড়ি সপ্তমী তিথিতে অদ্বৈতাচার্যের আবির্ভাব উৎসব পালিত হয় এই গোস্বামী বাড়িতে।

shantipur nabadwip
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy