Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

পুলিশকে দূরে রাখলেন অন্য উপাচার্য

ঠিক যেন উলটপুরাণ! দু’দিন আগে এক উপাচার্য ঘেরাও তুলতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকেছিলেন। বৃহস্পতিবার আর এক উপাচার্য কয়েক জন ছাত্রের উপরে হামলার অভিযোগ পেয়ে পত্রপাঠ পৌঁছে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য একটি ক্যাম্পাসে। পুলিশকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে বারণ করে নিজেই বন্ধ ফটক খুলে ভিতরে ঢুকলেন। ধরে ফেললেন কয়েক জন বহিরাগতকেও।

পরিচয়পত্র দেখছেন উপাচার্য সুরঞ্জন দাস। ছবি: সুদীপ আচার্য।

পরিচয়পত্র দেখছেন উপাচার্য সুরঞ্জন দাস। ছবি: সুদীপ আচার্য।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৪:৩৯
Share: Save:

ঠিক যেন উলটপুরাণ!

দু’দিন আগে এক উপাচার্য ঘেরাও তুলতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকেছিলেন। বৃহস্পতিবার আর এক উপাচার্য কয়েক জন ছাত্রের উপরে হামলার অভিযোগ পেয়ে পত্রপাঠ পৌঁছে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য একটি ক্যাম্পাসে। পুলিশকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে বারণ করে নিজেই বন্ধ ফটক খুলে ভিতরে ঢুকলেন। ধরে ফেললেন কয়েক জন বহিরাগতকেও।

প্রথম জন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী। দ্বিতীয় জন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস। শাসক দলের ঘনিষ্ঠ যাদবপুরের উপাচার্যের প্রচ্ছন্ন অভিযোগ ছিল বিরোধীদের দিকে। আর বৃহস্পতিবার রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের ঘটনায় বহিরাগতরা সবাই তৃণমূলের ছাত্র সংগঠনের লোক বলেই ছাত্র-শিক্ষকদের একাংশের অভিযোগ। এই অশান্তিতেও ঘুরেফিরে উঠে আসছে টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডার নাম।

ছাত্র-শিক্ষকদের অনেকেরই অভিযোগ, এ দিন দুপুরে শঙ্কুদেবের উপস্থিতিতে ক্যাম্পাসে একটি সভা হয়। তার কিছু পরেই গোলমাল শুরু। অভিযোগ, শারীরবিদ্যা বিভাগের স্নাতকোত্তর স্তরের কয়েক জন পড়ুয়ার উপরে হামলা হয়। ওই সময়ে একদল পড়ুয়া ও কিছু বহিরাগত মিলে

মূল ফটক বন্ধ করে দেয়।

খবর পেয়ে পরিস্থিতি সামলাতে সুরঞ্জনবাবু নিজেই সায়েন্স কলেজে গিয়ে গেট খুলে ঢোকেন। আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার পুলিশকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে নিষেধ করে ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলেন উপাচার্য। কলেজ চত্বরে ভিড় করে থাকা যুবকদের পরিচয়পত্রও দেখতে চান তিনি। কয়েক জন পরিচয়পত্র দেখাতে পারেননি। তাঁদের বেরিয়ে যেতে বলেন সুরঞ্জনবাবু।

গত জুলাইয়ে শারীরবিদ্যা বিভাগের শিক্ষিকা রৌশেনারা মিশ্রের (যিনি সিপিএম নেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের মেয়ে) বিরুদ্ধে সায়েন্স কলেজে বাম-রাজনীতি ছড়ানোর অভিযোগ তুলেছিল টিএমসিপি। শঙ্কু-বাহিনীর হুমকির জেরে সে বার নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে কয়েক দিন ক্লাস বয়কট করেছিলেন ছাত্রছাত্রীরা। এ দিনও রৌশেনারার ইন্ধনে গোলমাল বেধেছে বলে শঙ্কুর অভিযোগ। তিনি বলেন, “রৌশেনারাদেবীর প্রশ্রয়েই যাদবপুর-কাণ্ডের জেরে এসএফআই ও সিপিএম নেতারা মিলে কলেজে জোর করে ক্লাস বয়কট চালু করতে চাইছিলেন। জবরদস্তি করতে গিয়ে তাঁরাই টিএমসিপি-র এক ছাত্র নেতা-সহ কয়েক জনকে পেটান।”

রৌশেনারার কিন্তু দাবি, এ দিন ওই সময়ে তিনি রাজাবাজার ক্যাম্পাসেই ছিলেন না। সল্টলেক ক্যাম্পাসে একটি কনফারেন্সে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। সেখানে তাঁর সই রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য ধ্রুবজ্যোতি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সেখানে দেখাও হয়েছে। সুরঞ্জনবাবুও জানিয়েছেন, এ দিন সায়েন্স কলেজে গিয়ে তিনি রৌশেনারাকে দেখেননি।

ছাত্রছাত্রীদের অভিযোগ, কলেজ ইউনিয়ন রুমে শাসক দলের পান্ডা গোছের কয়েক জন ছাত্র নেতাই ঘুরেফিরে গোলমাল বাধাচ্ছেন। সৌরভ অধিকারী নামে এক যুবকের উল্লেখ করেছেন তাঁরা। শঙ্কুদেবের যদিও দাবি, সৌরভই আক্রান্ত। সান্ধ্য বিভাগে তথ্যপ্রযুক্তিতে এমএসসি-র ওই ছাত্র বহিরাগত ও কলেজের এসএফআই-এর হাতে মার খেয়ে মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাধীন বলে দাবি করেন শঙ্কু। তিনি আবার নিজের মোবাইল থেকেই কথা বলিয়ে দেন কেমিক্যাল টেকনোলজি-র শিক্ষক টিটো পারিয়ার সঙ্গে। টিটো বলেন, “সিপিএম-এসএফআই-এর হামলাতেই সৌরভ মার খেয়েছেন।”

শঙ্কুরা অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে পাশে পেয়েছেন। বহিরাগত তত্ত্ব উড়িয়ে পার্থবাবু বলেছেন, “আমি তো শুনলাম টিএমসিপি-র ছেলেরাই আক্রান্ত!”

এ দিন কলেজে গিয়ে দেখা যায়, জখম অবস্থায় বেরিয়ে আসছেন শারীরবিদ্যা শাখার এমএসসি তৃতীয় সেমেস্টারের কয়েক জন ছাত্র। চোখমুখ ফুলে গিয়েছে সৌম্যদেব ঘোষ, রাজদেব বন্দ্যোপাধ্যায়দের। ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছেন শ্রেয়সী দাস, পিয়ালি জাটি-রাও। রাজদেব জানান, তিনি আগে এসএফআই করতেন। শাসক দলের ছাত্রনেতাদের চাপে সব ছেড়ে দিয়েছেন। ওই ছাত্রছাত্রীরা জানান, আগামী সোমবার নবীন-বরণ অনুষ্ঠানের জন্য নাটকের মহড়া দিচ্ছিলেন তাঁরা। এটাই ছিল শেষ রিহার্সাল।

হঠাৎই যে ঘরে মহড়া হচ্ছিল, তার ছিটকিনি ধাক্কা মেরে খুলে ঢুকে পড়ে কয়েক জন। কার অনুমতিতে এ-সব অনুষ্ঠান হচ্ছে, জানতে চেয়ে রাজদেবকে টেনে নিয়ে যেতে চায় তারা। শ্রেয়সীর কথায়, “চেয়ারের ভাঙা টুকরো, ফাইবারের রড দিয়ে পিটিয়েছে ওরা। আমার মাথায় বাড়ি মেরেছে।” অভিযোগ, পিয়ালিকেও ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়।

বিজ্ঞান শাখার সচিবের ঘরে উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যকে কাঁদো-কাঁদো গলায় ছাত্রীরা বলছিলেন, “স্যার, এ রকম চললে বাড়ি থেকে কলেজে আসতেই দেবে না! ঘন ঘন এমন ঘটনা ঘটছে। যে কোনও দিন ল্যাবরেটরি ভাঙচুর হলেও অবাক হওয়ার নেই।” থমথমে মুখে শুনছিলেন সুরঞ্জনবাবু। দু’মাস আগে তাঁর আশ্বাসেই ক্লাস বয়কট তুলে নিয়েছিলেন ছাত্রছাত্রীরা। এ দিন ফের নিরাপত্তা নিয়েই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।

সুরঞ্জনবাবু বলেন, “খুবই দুভার্গ্যজনক ঘটনা! শিক্ষাঙ্গনে এই ধরনের ঘটনা ঠেকানোই আমাদের লক্ষ্য!” উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ কর্তাদের তৎপরতায় আক্রান্ত ছাত্রছাত্রীদের গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছনোর ব্যবস্থা করা হয়। নীলরতন সরকার মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হয় সৌম্য, রাজদেবদের। রাজদেব জানান, ভয়ে তাঁরা থানায় যেতে পারছিলেন না। পরে পুলিশ গিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে অভিযোগ নেয়। উপাচার্য জানান, ছাত্রদের মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলার অভিযোগের নিষ্পত্তি করতে সায়েন্স কলেজ ক্যাম্পাসে সিসিটিভি বসানো হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE