শহুরে হাওয়ায় প্রথম শীতের আমেজ। শেষ নভেম্বরের কলকাতার চারপাশে নতুন বইয়ের গন্ধ যেন বইপ্রেমীদের আরও চনমনে করে তোলে। সেই রেশ ধরেই এপিজে বাংলা সাহিত্য উৎসবের নবম কিস্তি, সৌজন্যে পার্ক স্ট্রিটের জনপ্রিয় অক্সফোর্ড বুকস্টোর। ২৪ থেকে ২৬ নভেম্বর তিন দিন ধরে বই, ভাষা, সাহিত্য নিয়ে কত রকম আলোচনা, তর্ক, বোঝাপড়া, মুগ্ধ করে রেখেছিল দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসা পাঠক, দর্শক ও শ্রোতাদের। হাজির ছিলেন শহরের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বরা। এ এক অন্য ধারার উৎসব!
অজানা কবিদের কবিতাপাঠে প্রখ্যাত কবি জয় গোস্বামী
২৪ নভেম্বরের সন্ধ্যায় উৎসবের নবম অধ্যায়ের উদ্বোধন করেন কবি জয় গোস্বামী। তাঁর অভিব্যাক্তি জুড়ে ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি এক গভীর বিশ্বাস। তাঁর কথাতেই ধরা পড়ল, “এক দল লেখক ও কবি থাকেন যারা মঞ্চারোহণপ্রিয়, আবার এক দল আছেন, যাঁরা নিজেদের লেখার টেবিলটিকেই মঞ্চ বলে মনে করেন। তবে এই দুই রকম মানুষই পাশাপাশি একসঙ্গে রয়েছেন, সঙ্গে রয়েছে উৎসবপ্রিয় মানুষদের আনন্দও।”
আলোচনা, কবিতা, বিতর্কের পাশাপাশি ছিল গানও
নানা রকম আলোচনা সভাতেই মেতে থেকেছে সাহিত্যপ্রেমী মানুষদের এই সমাবেশ। মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে শুরু করে সুকুমার রায়, নারীবাদী লেখালেখির একাল সেকাল থেকে গ্রাফিক্স নভেলের ধারা বিবেচনা- আলোচনা, তর্কসভা থেকে বাদ পড়েনি কিছুই। কথোপকথনে উঠে এসেছে রাজনীতি, কল্পবিজ্ঞান, ইদানীং কালের মিম, এমনকী সাময়িক পত্রিকার লেখালেখির মতো হরেক বিষয়।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম দ্বিশতবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনায় লেখক অভীক মজুমদার
মধুসূদন দত্তের কাজ নিয়ে আলোচনা সভার শেষে অন্যতম বক্তা অভীক মজুমদার বললেন, “সমাজমাধ্যম হোক বা অন্যান্য মাধ্যম, কোনও ক্ষেত্রেই সাহিত্যচর্চা এত কেন্দ্রীভূত হয় না। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় সাহিত্য সংক্রান্ত যা কিছু আলোচনা পরের সারিতে চলে গিয়েছে, তাকে আবারও প্রথম সারিতে ফিরিয়ে আনতে এবং নতুন প্রজন্মকে শেখার সুযোগ করে দিতে এই রকম উৎসবের জুড়ি নেই।”
অনুবাদের একাল-সেকাল নিয়ে আলোচনা
ভাষা ও সাহিত্যের নানা রকম শাখা-প্রশাখা নিয়ে মানুষের আবেগ প্রকাশ পেয়েছে বাংলা ভাষায় অনুবাদ বিষয়ক আলোচনার অন্যতম বক্তা অধ্যাপক চিন্ময় গুহর বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, “অনুবাদ হল বাংলা ভাষা-সাহিত্যের জগতে একটি জানলা, পৃথিবীর দিকে সেই জানলা খুলে না তাকালে মানুষ বাঁচতে পারবে না। অনুবাদের মাধ্যমেই ভাষা আজকের রূপ পেয়েছে"।
বইয়ের পাতার সীমানা পেরিয়ে বাংলা সাহিত্য নিয়ে আলোচনাসভায় বক্তারা
চলচ্চিত্র হোক কী বইয়ের পাতায় ধরা সাহিত্য, উৎসবের আমেজে এই সীমারেখা পেরিয়ে যেতে ডাক দিয়েছেন পরিচালক অরিন্দম শীল। তাঁর কথায়, “একে অপরের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার যে চল, তা হারিয়ে যেতে দিলে চলবে না। সাহিত্য হোক বা রুপোলি পর্দা, আদতে সবই জীবনধর্মী। তাই সাহিত্য মানেই যে শুধু বইয়ের পাতা তা নয়, ছবির পাশাপাশি এই আলোচনায় আরও প্রাধান্য পেয়েছে ওটিটি স্তরের নানা কাজ।”
সঞ্চালক রয় চৌধুরীর কথোপকথনে জমে উঠেছিল উৎসবের আড্ডা
সঞ্চালক রয় বলেন, “কথোপকথন আগেও ছিল। তবে বাংলা সাহিত্য জগতের নামজাদা যে ব্যক্তিত্বরা সামিল হয়ে সংগঠিত ভাবে এই উৎসব আয়োজন করেছেন, এই উদ্যোগ আগে হয়তো দেখা যায়নি কখনও। সচেতনতা তৈরি হয়েছে নানা ধাপে, নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা গড়ে উঠেছে।”
আলোচনায় উঠে এসেছে সাম্প্রতিককালের লেখালেখির চিত্র
সাহিত্যিক প্রচেত গুপ্তের মতে, “এই ধরনের উৎসব নিয়ে যত চর্চা বাড়বে, ততই মানুষের সাহিত্য, বই, গল্প-উপন্যাস নিয়ে ঝোঁক বাড়বে আজকের পাঠকদের মধ্যে। আমাদের সকলের আলোচনার মধ্যে দিয়ে যদি উৎসাহ ও আগ্রহ বাড়িয়ে তোলা যায়, তা হলে সেটাই সাহায্য করবে পথ চলতে ও এগিয়ে আসতে"।
মিম নাকি হাসির গল্প এই নিয়ে আলোচনায় মীর আফসার আলি
আজকের সমাজমাধ্যমের যুগে দৃষ্টিসুখের দাম এত বেড়ে গিয়েছে যে, তা মানুষের কল্পনা শক্তিকে আঘাত করছে নানা ভাবে। জোকস বনাম রসসাহিত্য নিয়ে দমফাটা হাসির আলোচনার শেষে কৌতুক শিল্পী মীর আফসার আলি বলেন, “মানুষ চায় বলেই কিন্তু এই রকম উৎসবের আয়োজন হয় আজও। এত পাঠক জড়ো হন, মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষায় এই রকম সভা শুধু বছরে এক বার কেন, বেশ কয়েক বার হওয়া উচিত।”
দর্শকদের মধ্যে উৎসবের জমাটি আনন্দ
তিন দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানে ছিলেন ওপার বাংলার সাহিত্যিক থেকে নারীবাদী লেখক, মনস্তত্ত্ববিদ সকলেই। তাঁদের হাত ধরে সাহিত্যের আঙ্গিকে বাংলা ভাষাকে নতুন ভাবে চিনতে শিখলেন কলকাতার বিশাল পাঠককুল।
বাংলা সাহিত্যের নানা ধারার আলোচনায় অভিনেতা-পরিচালক অঞ্জন দত্ত
বিজয়ার পরের বিষাদ ধরা দিল উৎসবের আমেজে ভেসে থাকা দর্শকদের চোখে। তবে 'আসছে বছর আবার হবে'র প্রতিজ্ঞার দিকে তাকিয়েই নবম বর্ষের সাহিত্য উৎসব সফল ও উজ্জ্বল।