Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
লালগড়ে অস্ত্র সন্ধান

থানায় ‘চর-সম্মেলন’, পরিচয় ফাঁসে উদ্বেগ

জঙ্গলমহলে মাওবাদী হিংসা নেই সাড়ে তিন বছর। কিন্তু মাওবাদীদের লুকনো আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলা-বারুদের একটা বড় অংশের সন্ধান এখনও মেলেনি। এর মধ্যে রয়েছে শিলদার ইএফআর ক্যাম্প থেকে লুঠ হওয়া কয়েকটি স্বয়ংক্রিয় রাইফেলও।

সুরবেক বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৫ ০৩:৫৪
Share: Save:

জঙ্গলমহলে মাওবাদী হিংসা নেই সাড়ে তিন বছর। কিন্তু মাওবাদীদের লুকনো আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলা-বারুদের একটা বড় অংশের সন্ধান এখনও মেলেনি। এর মধ্যে রয়েছে শিলদার ইএফআর ক্যাম্প থেকে লুঠ হওয়া কয়েকটি স্বয়ংক্রিয় রাইফেলও। গোয়েন্দাদের সন্দেহ, জঙ্গলমহলেরই কোথাও লুকনো রয়েছে এই অস্ত্রভাণ্ডার। আর তার সন্ধান পেতে মরিয়া পুলিশ এখন রীতি ভেঙে তাদের চরেদের বৈঠকে ডাকল থানায়। আর তাতেই পরিচয় প্রকাশ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করে বিপন্ন বোধ করছেন এই চরেরা।

গোয়েন্দা সূত্রের খবর, জঙ্গলমহলে মাওবাদী কার্যকলাপ বেশ কিছুটা স্তিমিত হলেও বিকাশ, রঞ্জিত পালের মতো নেতারা এখনও অধরা। এরই মধ্যে লালগড়ের সিজুয়া, ধরমপুরের মতো পঞ্চায়েতে দুর্নীতি, স্বজনপোষণের অভিযোগকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে মানুষের ক্ষোভ। গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, মানুষের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে মাওবাদীরা ফের তৎপর হলে এবং লুকনো অস্ত্র পেলে জঙ্গলমহল অশান্ত হয়ে উঠবে।

জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে জঙ্গলমহলে নতুন করে আন্দোলন গড়ে তোলার, নাশকতা ঘটানোর ক্ষমতা মনসারাম হেমব্রম ওরফে বিকাশের রয়েছে বলে গোয়েন্দাদের একাংশ মনে করেন। গোয়ালতোড় এলাকার মাকলি গ্রামের বিকাশ আদিবাসী সম্প্রদায়ের, সেটাও তাঁর বড় সুবিধে। ২০০৯-এর জুনে ধরমপুরে সিপিএম নেতা অনুজ পাণ্ডের বাড়ি ভাঙচুরের সময়ে বিকাশই কালাশনিকভ কাঁধে সাংবাদিক বৈঠক করেছিলেন। তাঁর স্ত্রী তারাও মাওবাদী নেত্রী। ফেরার অন্য নেতাদের মধ্যে অসীম মণ্ডল ওরফে আকাশ মূলত সংগঠক, রঞ্জিত পাল ওরফে রাহুল নাশকতামূলক কার্যকলাপে পারদর্শী।

বিকাশ ও মাওবাদী অস্ত্র ভাণ্ডারের হদিস চাওয়া হয়েছে স্পেশ্যাল পুলিশ অফিসার (এসপিও)-দের কাছে। পোশাকি নাম এসপিও হলেও ওঁরা আসলে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের চর হিসেবেই কাজ করেন। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া এবং পশ্চিম মেদিনীপুরে মোট এসপিও-র সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি, যাঁদের পরিচয় স্বাভাবিক ভাবেই গোপন রাখা হয়। মাসোহারা বাবদ এক জন এসপিও পান তিন হাজার টাকা, যা ব্যাঙ্ক অ্যকাউন্টে জমা পড়ে।

কিন্তু পুলিশের সৌজন্যে সেই গোপনীয়তাই আর রক্ষা করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ বহু এসপিও-র। পুলিশ সূত্রেই খবর, সোমবার লালগড় থানায় এলাকার এসপিও-দের নিয়ে বৈঠক ডাকা হয়। সিভিক ভলান্টিয়াররাও ছিলেন সেখানে। কারণ, রাজ্য পুলিশের
শীর্ষ স্তরে খবর পৌঁছেছে, ছত্তীসগঢ় ও ঝাড়খণ্ডে পুলিশের সঙ্গে
লড়াইয়ে জখম মাওবাদীরা চিকিৎসা করাতে ঢুকেছে লালগড়, বিনপুরের মতো তল্লাটে— যেখানে তাদের সহমর্মী লোকজন রয়েছেন। এই ব্যাপারে সতর্ক করতেই থানায় বৈঠক ডাকা হয়েছিল। এক এসপিও-র বক্তব্য, ‘‘বৈঠকে তো জেনে গেলাম, আমি ছাড়া অন্য এসপিও কারা আছে। তারাও জেনে গেল আমার কথা। এটা কিন্তু জানার কথা নয়।’’

আবার চলতি মাসেই একটি ফর্মে সই করানো হয় এসপিও-দের। এক এসপিও বলেন, ‘‘নিযুক্ত হওয়ার সময়ে সাদা পোশাকে এক অফিসার বাড়ি থেকে গোপনে সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র ও ব্যাঙ্কের পাশবইয়ের প্রতিলিপি নিয়ে যান। ওই নথি যে কেউ পেতে পারে। কিন্তু সই করানোর বিষয়টি বিপজ্জনক। পুলিশের সঙ্গে যে আমার যোগসূত্র রয়েছে, ফর্মে সই করায় সেটা তো নথিবদ্ধ হয়ে গেল!’’

রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষকর্তার যুক্তি, ‘‘ব্যাঙ্কের ইসিএস-এর জন্য এটা করা হয়েছে।’’ তবে পুলিশেরই অন্য সূত্রের খবর, এক শ্রেণির অফিসার ভুয়ো কিছু নাম নথিভুক্ত করেছিলেন এসপিও দেখিয়ে, সরকারি টাকা আসলে ঢুকছিল তাঁদের অ্যাকাউন্টেই। এটা বন্ধ করতেই এসপিও-দের পরিচয় নথিবদ্ধ করে রাখা হচ্ছে। কিন্তু এক এসপিও-র বক্তব্য, ‘‘পুলিশের দুর্নীতির মাসুল আমরা কেন দেব? মাওবাদীরা আজ নেই, কিন্তু কাল যে ফিরে আসবে না, সেটা কে বলতে পারে? তখন তো সবার আগে আমার বিপদে পড়ব।’’

মাওবাদীদের ফেরার আশঙ্কা যে তৈরি হয়েছে, সেটা অস্ত্রভাণ্ডার ও বিকাশের হদিস পেতে পুলিশের মরিয়া চেষ্টা থেকেই পরিষ্কার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE