E-Paper

অন্যের পাশে থাকাই সন্তানকে পাওয়া

ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃতের অঙ্গদান সম্ভব নয়। ২০১৯ সালের ৬ এপ্রিলের সেই দিনটার কথা বলতে গিয়ে গলা বুজে আসে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মী অভিজিৎ চক্রবর্তীর।

শান্তনু ঘোষ

শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৬:১৫
Picture of a family.

আরুষের ছবি হাতে বাবা ও মা। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য

তখন থেমে গিয়েছে কার্ডিয়াক মনিটরের ‘বিপ’ শব্দটা। শ্বাসপ্রশ্বাস চালানোর যন্ত্র (ভেন্টিলেশন)-ও খুলে দেওয়া হয়েছে। আইসিইউ-এ ১৪ বছরের ছেলের মুখ দেখে, নিজের মনকে শক্ত করে বাবার প্রশ্ন ছিল, ‘ডাক্তারবাবু ওর অঙ্গদান কি সম্ভব?’ উত্তর এসেছিল, ‘না।’

ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃতের অঙ্গদান সম্ভব নয়। ২০১৯ সালের ৬ এপ্রিলের সেই দিনটার কথা বলতে গিয়ে গলা বুজে আসে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মী অভিজিৎ চক্রবর্তীর। শনিবার দুপুরে দমদমের বাড়িতে বসে বললেন, ‘‘অন্যের মধ্যে তো নিজের ছোট্ট ছেলেটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলাম না। কিন্তু ওকে নিয়ে ২৬ দিনের লড়াইয়ের সময়ে হাসপাতালে কাউকে হাসতে, কাউকে কাঁদতে দেখেছি। তাই, আমার আরুষকে অন্য বাচ্চাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি মাত্র।’’ ক্যানসারে আক্রান্ত শিশুদের পাশে থাকতে আরুষের বাবা অভিজিৎ ও পিসি জয়িতা মিলে তৈরি করেছেন একটি ট্রাস্ট। যার জন্ম আরুষের মৃত্যুর আট মাস পরে।

এ বার তাঁরা গড়ে তুলছেন একটি বাড়ি। নিউ টাউন সংলগ্ন হাতিশালা মৌজা এলাকায় দু’কাঠা জমিতে মাথা তুলবে সেই দোতলা বাড়ি। আজ, রবিবার তার শিলান্যাস হবে। অভিজিৎ, জয়িতা এবং আরুষের মা, হলদিয়ায় ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশনে কর্মরত ছন্দার স্বপ্ন, আগামী দেড় বছরের মধ্যে গড়ে উঠবে ওই বাড়ি। যেখানে বিনামূল্যে থাকার সুযোগ পাবেন ১২-১৩ জন ক্যানসার আক্রান্ত শিশু ও তাদের বাবা-মায়েরা। দমদমের ফ্ল্যাটে বসার ঘরের দেওয়ালে টাঙানো আরু‌ষের বড় ছবি। সদা হাসি মুখের ‘তাতাই’-এর দিকে তাকিয়ে তার আদরের ‘পিসিমণি’ জয়িতা বলেন, ‘‘দূরদূরান্ত থেকে অনেক শিশু ক্যানসারের চিকিৎসা করাতে শহরে আসে। কেমোথেরাপির পরে হাসপাতালের কাছাকাছি তাদের থাকার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু অনেক দরিদ্র পরিবারের পক্ষে বাড়ি ভাড়া করে থাকা সম্ভব হয় না। ওদের জন্যই বাড়ি তৈরির ভাবনা।’’

হাতিশালার ওই বাড়ি থেকে হাসপাতালে যাতায়াতের জন্য থাকবে গাড়ির ব্যবস্থা। ভিতরে বাচ্চাদের মানসিক আনন্দের জন্য ছোট্ট থিয়েটার হল, খেলার ঘর থাকবে। থাকবেন মনোবিদও। ওই বাড়িটি থেকে সাত-আট কিলোমিটার দূরেই রয়েছে টাটা মেডিক্যাল সেন্টার (টিএমসি)। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেখানেই ভর্তি ছিল অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়া আরুষ। ২০১৯-এর ১০ মার্চ আচমকা তার জ্বর আসে। হলদিয়া থেকে ছেলেকে নিয়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন ছন্দা। অভিজিৎ জানাচ্ছেন, চিকিৎসক দেখেই আরুষকে হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেন। সেই সময়ে আর জ্বর না থাকলেও, কিছু পরীক্ষার পরে জানা যায়, ‘অ্যাকিউট মায়লয়েড লিউকোমিয়া’-য় আক্রান্ত সে। শহরের এক বেসরকারি হাসপাতালে তিন-চার দিন থাকার পরে আরুষকে টিএমসি-তে নিয়ে যান অভিজিতেরা।

টানা কয়েক দিন পরে আইসিইউ থেকে বেরিয়ে সাধারণ শয্যায় মায়ের কোলে এসেছিল আরুষ। মনে আশার আলো জ্বললেও দিন তিনেক পরেই ফের আইসিইউ। সেখানেই ৬ এপ্রিল সকালে ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয় আরুষকে। রাতে সব শেষ। যদিও সেই শেষ থেকেই আজকের শুরুর চিন্তা বলে জানাচ্ছেন অভিজিৎ। তাই পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোতলা বাড়িটি তৈরি করতে চান তাঁরা। তাতে সহযোগিতা করছেন টিএমসি-তে আরুষের চিকিৎসক অর্পিতা ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘‘আরুষের বাবা-মা, পিসি প্রচুর কাজ করেন। করোনার সময়ে পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে সেখানকার ২০টির মতো বাচ্চার পড়াশোনা, খাওয়াদাওয়ার দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন নিজেদের কাঁধে। আসলে সকল শিশুর মধ্যেই নিজের সন্তানকে ছড়িয়ে দিয়েছেন অভিজিৎ।’’

বর্ধমানে কর্মরত অভিজিৎ সপ্তাহে শনি ও রবিবার থাকেন কলকাতায়। এই দু’দিন টিএমসি, সিএনসিআই, ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথে ঘুরে খোঁজার চেষ্টা করেন আরও অনেক আরুষকে। চেষ্টা করেন সাধ্যমতো তাদের পাশে থাকার। ফ্ল্যাটে কিছু ক্ষণের নিঃস্তব্ধতা কাটিয়ে, মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী কন্যার বাবা অভিজিৎ বললেন, ‘‘আমার কাছে প্রতিটি বাচ্চাই যে আরুষ।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Cancer Health West Bengal

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy