মহিলাদের কাজের বাজারে অংশ নেওয়ার হার আগের তুলনায় বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের কাজে অংশগ্রহণের হার এখনও অনেক কম। গোটা দেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে একই ছবি। রাজ্যে পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে কাজে অংশগ্রহণের হারে বিস্তর ফারাক।
কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, পশ্চিমবঙ্গে পুরুষদের ক্ষেত্রে কাজের বাজারে অংশগ্রহণের হার ৭৮ শতাংশ। সেই তুলনায় মহিলাদের কাজের বাজারে অংশগ্রহণের হার মাত্র ৩০.৭ শতাংশ। অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গে ১৫ বছরের বেশি বয়সি ১০০ জন পুরুষের মধ্যে ৭৮ জন হয় কাজ করছেন, বা কাজ খুঁজছেন বা কাজ করার জন্য তৈরি রয়েছেন। কিন্তু ১০০ জন মহিলার মধ্যে মাত্র ৩০ জনের মতো মহিলা কাজ করছেন, কাজ খুঁজছেন বা কাজ করবেন বলে তৈরি রয়েছেন।জাতীয় স্তরে ছবিটা কেমন? গোটা দেশে পুরুষদের মধ্যে কাজের বাজারে অংশগ্রহণের হার ৭৫ শতাংশ। কিন্তু মহিলাদের মধ্যে কাজের বাজারে অংশগ্রহণের হার মাত্র ২৫.৫ শতাংশ। অর্থাৎ, পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে কাজে অংশগ্রহণের হারে ফারাক ৪৯.৫ শতাংশ বিন্দু। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই ফারাক ৪৭.৩ শতাংশ বিন্দু।
প্রথমে নোট বাতিল, তারপরে কোভিডের ধাক্কায় বহু ক্ষুদ্র, ছোট শিল্প বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সামগ্রিক ভাবে বেকারত্বের হার বেড়ে গিয়েছিল। পরিযায়ী শ্রমিকদের সপরিবারে শহর থেকে গ্রামে ফিরতে হয়েছিল। তার ফলে মহিলাদের কাজের সুযোগ কমে গিয়েছিল. মহিলাদের একটা বড় অংশ কাজ খোঁজাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রকের তথ্য বলছে, মহিলাদের কাজের বাজারে অংশগ্রহণের হার বেড়েছে। মহিলাদের জনসংখ্যার মধ্যে কর্মীর হারও বেড়েছে। পুরুষ-মহিলাদের মধ্যে এখনও বিস্তর ফারাক। উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব ও মধ্যপ্রদেশে এই ফারাক সবথেকে বেশি। কেরল, হিমাচল প্রদেশ ও জম্মু-কাশ্মীরে এই ফারাক সবথেকে কম। এই তিন রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে পুরুষ-মহিলার কাজের বাজারে অংশগ্রহণের হারে ফারাক অনেকটাই বেশি।
কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রকের পিএলএফএস (পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে) রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে দিল্লির ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন ইন্টারন্যাশনাল ইকনমিক রিলেশনস’ শনিবার একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। রিপোর্ট বলছে, ২০২৪-এর জুলাই-সেপ্টেম্বরে কাজের বাজার, বিশেষ করে শহরের কাজের বাজারে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। জনসংখ্যার মধ্যে কর্মরত মানুষের হার বাড়ছে। তার মূল কারণ হল, মহিলাদের নিয়োগ বাড়ছে। পাকা মাইনের চাকরি বাড়ছে। তবে শহরের কর্মীদের মাত্র অর্ধেক এখন পাকা বেতনের চাকরি করেন। দশ জনের মধ্যে পাঁচ জন স্থায়ী বেতনেরচাকরি করলেও বাকি চার জন স্বনিযুক্ত, অন্য একজন ঠিকা কর্মী। রিপোর্ট অনুয়ায়ী, তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার কমছে। কিন্তু দুশ্চিন্তার কারণ হল, কর্মীদের বেতন একই জায়গায় থমকে থাকা। টাকার অঙ্কে বেতন বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধির হিসেব ধরলে বাস্তবে বেতন মোটেই বাড়ছে না। ফলে একইসঙ্গে কাজের বাজারে অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জের ছবি ফুটে উঠেছে।
গত বুধবার পশ্চিমবঙ্গের বাজেট বক্তৃতায় রাজ্যের অর্থ প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেছিলেন, রাজ্য সরকার বেকারত্বের হার কমিয়ে আনতে সফল। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, জানুয়ারি মাসে দেশে বেকারত্বের হার ছিল প্রায় ৮ শতাংশ। সেই তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের বেকারত্বের হার ছিল ৪.১৪ শতাংশ। তিনি বেসরকারি সংস্থা সিএমআইই (সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি)-র পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করেছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান থেকে তৈরি রিপোর্ট বলছে, পশ্চিমবঙ্গের শহরাঞ্চলে ২০২৪-এর জুলাই-সেপ্টেম্বরে বেকারত্বের হার ছিল ৫.৫ শতাংশ। ২০২৩-এ ওই তিন মাসে বেকারত্বের হার ছিল ৫.১ শতাংশ। তারপরে বেকারত্বের হার বাড়তে বাড়তে গত এপ্রিল-জুনে বেকারত্বের হার ৬ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। সেই তুলনায় জুলাই-সেপ্টেম্বরে বেকারত্বের হার কিছুটা কমে ৫.৫ শতাংশে নেমেছে। তবে তরুণদের মধ্যে বা ২৯ বছরের কম বয়সিদের মধ্যে বেকারত্বের হার এর থেকে অনেক বেশি, ১৫ শতাংশ।
রাজ্য সরকারের কর্তাদের বক্তব্য, সরকারি হিসেবেও গোটা দেশের থেকে পশ্চিমবঙ্গে বেকারত্বের হার কম। ২০২৪-এর জুলাই-সেপ্টেম্বরে বেকারত্বের হার ছিল ৬.৬ শতাংশ। সেই তুলনায় রাজ্যে বেকারত্বের হার ৫.৫ শতাংশ ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান অবশ্য বলছে, এক বছরে দেশের ১১টি শহরে বেকারত্বের হার কমেছে, ১১টি রাজ্যে বেড়েছে। যে সব রাজ্যে বেকারত্বের হার বেড়েছে, তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে কর্নাটক, গুজরাত, কেরল, উত্তরাখণ্ড, ওড়িশা রয়েছে। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন ইন্টারন্যাশনাল ইকনমিক রিলেশনস-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, বেকারত্বের মাপকাঠিতে ওড়িশায় সবথেকে অবনতি হয়েছিল। সেখানে শাসক দল বিপুল ভোটে বিধানসভা নির্বাচনে হেরে গিয়েছে।
কর্মীদের বেতন বৃদ্ধি থমকে থাকা নিয়ে এই রিপোর্ট বলছে, গত ছয় বছরে রাজ্যগুলির মধ্যে বেতন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোনও সামঞ্জস্য দেখা যাচ্ছে না। ২০১৮-তে পশ্চিমবঙ্গে মাসিক গড় বেতন ছিল সবথেকে কম। তবে গত ছয় বছরে পশ্চিমবঙ্গে বেতন বৃদ্ধির হার যথেষ্ট বেশি। কর্নাটক, তেলঙ্গানা, হরিয়ানাতে সবথেকে বেশি বেতন বৃদ্ধি দেখা গিয়েছে। ওড়িশা, পঞ্জাব, অসমে বেতন বৃদ্ধির হার সবথেকে কম।
কর্মক্ষেত্র যেমন
পশ্চিমবঙ্গে পুরুষদের কাজের বাজারে অংশগ্রহণের হার ৭৮%, মহিলাদের মাত্র ৩০.৭%।
২০২৪-এর জুলাই-সেপ্টেম্বরে পশ্চিমবঙ্গে শহরাঞ্চলে বেকারত্বের হার ছিল ৫.৫%, তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল ১৫%। এক বছর আগে এই হার ছিল যথাক্রমে ৫.১% ও ১৫.৫%।
২০১৮-তে পশ্চিমবঙ্গে মাসিক গড় বেতন ছিল দেশের মধ্যে সবথেকে কম।
গত ছয় বছরে বেতন বৃদ্ধির হারে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যগুলির মধ্যে প্রথম সারিতে।
সূত্র: কাজের বাজার নিয়ে ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন ইন্টারন্যাশনাল ইকনমিক রিলেশনস’-এর রিপোর্ট
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)