বিজ্ঞানের ক্লাসে হঠাৎ কেঁদে ওঠায় তৎক্ষণাৎ অভিভাবককে ডেকে মৌমিতাকে (নাম পরিবর্তিত) বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন শিক্ষিকা। তাঁর যুক্তি ছিল, ‘‘মৌমিতার কান্নার জন্য অন্য পড়ুয়াদের অসুবিধা হচ্ছে।’’ তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করে, প্রতিবাদ করেও লাভ হয়নি। পরের দিন দক্ষিণ কলকাতার ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি পুলিশ ডেকে আনেন। দীর্ঘ আলোচনার পরে বিষয়টির মীমাংসা হলে অবশ্য আর মৌমিতাকে ক্লাস ছেড়ে বাড়ি ফিরতে হয়নি। পরীক্ষার সময়ে তার জন্য তৈরি করা হচ্ছে আলাদা প্রশ্নপত্রও।
স্কুলে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের বিরূপ ব্যবহার পাওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। দিন দুয়েক আগেই ১০ বছরের একটি অটিস্টিক ছেলেকে শিক্ষকের মারধরের ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। নয়ডার এক স্কুলে শিক্ষকের এমন কাজে দেশ জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। প্রশ্ন ওঠে, ছেলেটি যে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন, তা জানার পরেও শিক্ষক এমন কাজ করেন কী ভাবে? এ রাজ্যেও এমন একাধিক ঘটনা ঘটার পরে অভিভাবকেরা সরব হয়েছিলেন বন্ধ ঘরে থেরাপি করানোর বিরুদ্ধে।
বিশেষ শিক্ষক কাকলি কর বলছেন, ‘‘অটিজ়ম এবং অন্য প্রতিবন্ধকতার জন্য বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন বাচ্চাদের প্রকাশভঙ্গি আলাদা হয়। এ ক্ষেত্রে বোঝার চেষ্টা করতে হবে, বাচ্চাটি কান্নার মাধ্যমে তার আপত্তি জানানোর চেষ্টা করছে কিনা! তা না বুঝে তার উপরে রাগারাগি করলে কোনও ফল হবে না। এতে সুস্থ সমাজ গড়ে ওঠা কঠিন।’’
দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের সঙ্গে কাজ করছেন হুগলির উত্তরপাড়ার শিল্পী শৈবাল মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘দীর্ঘদিন ধরে ওঁদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, ধৈর্য এবং সংবেদনশীলতা— এই দু’টি থাকা অতি আবশ্যক। প্রতিটি বাচ্চার প্রকাশভঙ্গি আলাদা। তা বোঝার চেষ্টা না করে কোনও কাজ করানো উচিত নয়। এর জন্য সবচেয়ে সহজ রাস্তা হল আগে ওদের বন্ধু হওয়া। তা হলে অনেক অসাধ্যসাধনই সম্ভব।’’
বিশেষ অভিভাবক সঞ্জীব পাল যেমন ঠিক এই সূত্র ধরেই ছেলে আয়ুষ্মান এবং তার বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন বন্ধুদের নিয়ে খেলাধুলা চালিয়ে যাচ্ছেন বাঘা যতীন এলাকার মাঠে। সমমনস্ক অভিভাবকদের নিয়ে নিজের বাড়ির ছাদে প্রথমে খেলা শুরু করেছিলেন। ধীরে ধীরে খেলোয়াড়ের সংখ্যা বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ছেলেমেয়েদের বন্ধুর বড় অভাব হয়। ছোটবেলায় আমরা যেমন বিকেলে খেলতাম, ঠিক সেই ভাবেই আমাদের বাচ্চাদের নিয়ে খেলাধুলো শুরু করি। তাই এখন শনিবার হলেই বাচ্চারা মুখিয়ে থাকে মাঠে যাওয়ার জন্য।’’ কিন্তু এতগুলো বাচ্চাকে সামলানো কি সহজ? তাঁর কথায়, ‘‘কোনও কিছু অপছন্দ হলে ওরা নিজেরাই বুঝিয়ে দেয়। সেটা মেনে চলতে হয়। তা ছাড়া বাকি অভিভাবকেরা তো আছেনই সাহায্য করার জন্য।’’
কিন্তু সহমর্মিতা, ধৈর্যের মাধ্যমে অটিস্টিক মানুষদের পাশে দাঁড়ানো, বন্ধু হয়ে ওঠা সম্ভব হলেও কার্যক্ষেত্রে তেমনটা কমই হয় বলে জানাচ্ছেন অটিস্টিক শিশুদের অভিভাবকেরা। এমনকি, এখনও পরিকাঠামোর অভাবের অজুহাত দিয়ে বহু স্কুলই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পড়ুয়াদের ভর্তি পর্যন্ত নিতে চায় না। আজ, বুধবার বিশ্ব অটিজ়ম দিবসে তাই অভিভাবকেরা দাবি তুলছেন, সমান অধিকার পাক তাঁদের অটিস্টিক সন্তানেরাও।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)