Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

শহরতলির বাজারে পুনর্জন্ম ‘বুড়িমা’র

‘‘স্যর এ দিকে আসুন। চকোলেট নেবেন তো?’’ রাস্তার পাশের ছোট্ট পাঁচিল টপকে লাফিয়ে আমার সামনে এসে পড়ল হাফপ্যান্ট, খালি গা বছর পনেরোর ছেলেটা।

শুভাশিস ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৫ ০১:০০
Share: Save:

‘‘স্যর এ দিকে আসুন। চকোলেট নেবেন তো?’’

রাস্তার পাশের ছোট্ট পাঁচিল টপকে লাফিয়ে আমার সামনে এসে পড়ল হাফপ্যান্ট, খালি গা বছর পনেরোর ছেলেটা।

কিছুটা দম নিয়ে বলল, ‘‘আমাদের কাছে সেরা চকোলেট রয়েছে। ‘বুড়ি-মা স্পেশাল’। এখানকার লোকাল নেবেন না। ভাল না। আমাদেরটা এক্কেবারে ‘বুড়ি-মা’-র ফ্যাক্টরিতে তৈরি জিনিস। বিশাল আওয়াজ। কোনও চকোলেট ধারেকাছে আসবে না। তবে একটু দাম বেশি। ১০০ পিসের প্যাকেট ১৭০ টাকা। যেমন দাম, তেমন জিনিস। একটুও ঠকবেন না।’’ প্রায় এক নিঃশ্বাসেই সব কথা শেষ করে ফেলল ছেলেটা। তার পর বলল, ‘‘নেবেন তো?’’

একদা চকোলেট বোমার বাজিমাত করা ‘ব্র্যান্ড’, দক্ষিণ শহরতলির শব্দবাজির বাজারে মৃত ‘বুড়ি-মা’ ফের প্রাণ ফিরে পেয়েছেন। ‘বুড়ি-মা’ চকোলেটের আওয়াজের সুখ্যাতি শুনতে শুনতে ওই কিশোরের সঙ্গে হাঁটা শুরু। মিনিট দশেক পরে রাস্তার পাশে সরু গলি দিয়ে কিছুটা এগিয়ে একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল ছেলেটা। বাড়ির দরজায় ঘা দিয়ে বলল, ‘জেঠিমা, পার্টি আছে।’’ কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে বেরোলেন বছর পঞ্চাশের এক মহিলা। আগন্তুকের পা থেকে মাথা চোখ বুলিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘‘ক’প্যাকেট নেবেন?’’ বললাম, পাঁচ। পাশে দাঁড়ানো ছেলেটি বলল, ‘‘জেঠিমা, উনি ‘বুড়ি-মা’ নেবেন।’’ প্রায় ঘরের দিকে পা বাড়িয়েও ঘুরে দাঁড়ালেন মহিলা। বললেন, ‘‘দাম কিন্তু বেশি। সরাসরি কোম্পানির ঘর থেকে আনা। দারুণ জোরে ফাটবে।’’ তার পরে ডেকে নিলেন বাড়ির ভিতরে।

একটি ছোট ঘরে বসালেন মহিলা। ঘরের মধ্যে আতসবাজিও আছে। এক পাশে কাঠের চৌকির উপরে চরকি, রংমশাল, হাউই অনেক ধরনের বাজির প্যাকেট থরে থরে সাজানো। মহিলা বললেন, ‘‘একটা অনুরোধ। চকোলেটের সঙ্গে অল্প কিছু আতসবাজিও নিন। ব্যাগের তলায় চকোলেট রেখে উপরে আতসবাজি দিয়ে ঢেকে দেব। আপনারও নিয়ে যেতে সুবিধা হবে।’’ জিজ্ঞেস করলাম, আতসবাজিও কী ‘বুড়িমা’র?’’ জবাব এল, ‘‘না না, আমাদের নিজেদের কারখানার তৈরি। শুধু চকোলেট বুড়ি-মা কোম্পানি থেকে আনা হয়। আমার ছেলে নিয়ে আসে। কয়েক বার আমিও গিয়েছি।’’ জিজ্ঞেস করলাম, কোম্পানিটা কোথায়? মহিলা বললেন, ‘‘আগরপাড়ায়।’’ ফের প্রশ্ন, ‘‘উত্তর ২৪ পরগনার আগরপাড়া তো?’’ এ বার জবাব, ‘‘অতশত বলতে পারব না। যদি আওয়াজ শুনতে হয় তো আশু (পথ-প্রদর্শক ছেলেটি) বাঁশবাগানে নিয়ে ফাটিয়ে দেখিয়ে দেবে।’’

যতদূর জানি, বুড়ি-মা চকোলেট বোমার কারখানা ছিল হাওড়া জেলায়। তবু কথা না বাড়িয়ে পাঁচ প্যাকেট থেকে চকোলেট তিন প্যাকেটে নামিয়ে আনলাম। অজুহাত— চকোলেট ঢাকতে বাড়তি আতসবাজি কিনতে হচ্ছে। বাজেটে কুলোচ্ছে না। তাতে অবশ্য কিছু বললেন না ‘জেঠিমা’। ছোট সাদা একটি ব্যাগে তিন প্যাকেট চকোলেট ভরে তার উপর কয়েক প্যাকেট চরকি ও হাউই চাপিয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘৫৭০ টাকা দিন।’’ সাড়ে পাঁচশো টাকা জেঠিমার হাতে দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। সঙ্গে আশু, আমার পথ-প্রদর্শক। বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে জেঠিমা আশুকে বললেন, ‘‘বাবুকে বড় রাস্তায় তূলে দিয়ে আয়।’’ আশু চলল সঙ্গে। বড় রাস্তায় আমাকে পৌঁছে দিয়েই ফের বাড়ির দিকে দে ছুট!

বেশ কয়েক বছর ওই বাজির বাজারে যাতায়াতের সুবাদে কয়েক জন আতসবাজি ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। বড় রাস্তার দু’ধারে সারি দিয়ে স্টল। এক পরিচিতের দোকানে গিয়ে বসলাম। ‘বুড়ি-মা’ রহস্যভেদ করতেই হবে! আর তা করতে পারবেন স্থানীয় এই ব্যবসায়ীরাই। হাতে আতসবাজির ব্যাগ। ওই ব্যবসায়ী জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘এত অল্পবাজি নিলেন?’’ বললাম, ‘‘না এ বার তো বাজারে ‘বুড়ি-মা’ চকোলেট ফিরে এসেছে শুনলাম। তাই তিন প্যাকেট নিয়েছি। সেগুলোই আতসবাজি দিয়ে ঢেকেছি।’’ বুড়ি-মা চকোলেটের নাম শুনেই ওই ব্যবসায়ীর ঠোঁটের কোণে হাসি। বললেন, ‘‘আগে চা খান। ওটা ধান্দাবাজি। লোক ঠকানোর ব্যবসা। এখানকার তৈরি চকোলেটের প্যাকেটে ‘বুড়ি-মা’ লেবেল সেঁটে ৪০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করছে। কিছু ব্যবসায়ী এ বার এই নতুন ফন্দি এঁটেছে। কিছু ছেলে-ছোকরা ছেড়ে রেখেছে আশপাশে। ওরাই ‘বুড়ি-মা’ চকোলেট বলে কারখানায় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করাচ্ছে। প্যাকেট প্রতি ছেলেগুলোর ১০ টাকা কমিশন। ১০০ চকোলেটের ১২০ টাকা দামের প্যাকেট ১৮০ টাকায় বিক্রি করছে। সব এখানেই তৈরি হয়েছে। আপনিও পারেন দাদা! আমিও তো চকোলেট বিক্রি করি। এক বার আমাকে জিজ্ঞেস করবেন তো!’’ জি়জ্ঞেস করলাম, আপনার চকোলেটের প্যাকেটের দাম কত? ওই ব্যবসায়ী মুচকি হেসে বলেন, ‘‘বুড়ি-মা লেবেল মারা প্যাকেট ১৬০ আর এমনি প্যাকেট ১২০ টাকা।’’ বললাম, ‘দাদা আপনিও করছেন? মানে, ধান্দাবাজি?’ মুচকি হেসে ব্যবসায়ীর জবাব, ‘‘আমার তো অনেক তৈরি হয়েছে। বেচতে হবে তো। সরু কাগজে লেবেল তৈরিতে আর কী খরচ! কিছুই না।’’ বলতে বলতেই ইশারায় এক কর্মচারীকে ডেকে বললেন, ‘‘দাদাকে দু’প্যাকেট বুড়ি দে।’’ তার পরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘টাকা লাগবে না। আপনি তো বন্ধু মানুষ।’’ ওই কর্মচারী দু’ প্যাকেট ‘বুড়ি-মা’ লেবেল মারা চকোলেট নিয়ে হাজির। সে দুটোও ব্যাগে ভরে রওনা দিলাম। পরে বাড়ি ফিরে আমার এক দাদার কাছে শুনলাম, বুড়ি-মা বছর পনেরো আগে মারা গিয়েছেন। বুড়ি-মা শব্দবাজিও আর তৈরি হয় না। তবে এ বার দক্ষিণ শহরতলির বাজারে ‘বুড়ি-মা’ ফের জন্ম নিয়েছেন। আর আশু বাবাজি বুড়ি-মা চকোলেটের কমিশনার। আমাকে বড় রাস্তায় ছেড়ে দিয়েই জেঠিমার কাছে কমিশন আনতে দৌড়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE